শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অনেকটা মৌচাক ও মৌমাছির মতো। দুটি দেশই একে অপরের প্রতি বিশ্বাসপূর্ণ ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক রেখে চলতো। হাসিনার আমলে চিনের সঙ্গেও একটা ভালো ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, যা ভারত মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান তদারকি সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় এসেই যে কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার ইঙ্গিত ছিল। হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে হওয়া যাবতীয় চুক্তি ও প্রকল্প প্রথমেই আটকে দেওয়ার হুশিয়ারি দেওয়া হয়। কোনওটি আবার আটকেও দেওয়া হয়। বিভিন্ন চলমান প্রকল্প, যার মধ্যে অন্যতম ট্রানজিট প্রকল্প স্থগিত করে পুনরমূল্যায়ন করার অজুহাতে। ভারত সরকার তখনও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। যত সময় গড়িয়েছে ততই বাংলাদেশের ভারত বিরোধিতা আরও প্রকাশ্যে এসছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের মাখামাখি। ভারত পুরো বিষয়ের উপর কড়া নজর রাখলেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি তখনও।
কিন্তু গত মার্চে চীন সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যখন ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে ল্যান্ড লকড বলে কটাক্ষ করে চিনকে আহ্বান জানালেন বাংলাদেশে। চীনে দাঁড়িয়ে ইউনূসের দাবি ছিল বাংলাদেশ নাকি “অনলি গার্ডিয়ান অফ দ্য ওসেন”। সেই প্রথম ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করল। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করে দিলে ভারত। এই সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের স্থল, বিমান ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে বিদেশে বাণিজ্য করতে পারতো। এতে তাঁদের যেমন সময় ও খরচ বাঁচতো, তেমনই লাভের অঙ্ক বাড়তো। এই ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পর মাথায় হাত পড়ে বাংলাদেশের রফতানিকারক সংস্থাগুলির কর্তাদের। সে দেশের বাণিজ্য খরচ হুহু করে বেড়ে যায়। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস থামেননি। তিনি ফের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলেন, এবার চট্টগ্রাম বন্দরে দাঁড়িয়ে। এরপরই ভারত নিল দ্বিতীয় বড় পদক্ষেপ। ভারত বাংলাদেশের জন্য সমস্ত স্থলবন্দরের দরজা বন্ধ করে দিল। ঢাকাকে জানানো হল, এখন থেকে যা বাণিজ্য হবে সবটাই সমুদ্র পথে। এখানেই বাংলাদেশের বাণিজ্য পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়। যে উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটা রাজ্য নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের লাগাতার হুমকি, বাংলাদেশী রপ্তানিকারকরা সেই সেভেন সিস্টার্সেই তাদের সামগ্রি রফতানি করতে পারছে না। ক্ষতির পরিমান কয়েকশো কোটি। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম সূত্রেই জানা যাচ্ছে, সে দেশের ব্যাবসায়িক সংগঠন, বাণিজ্য সংস্থাগুলি ইউনূস সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে ক্রমাগত। ভারতের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে স্থলবন্দরগুলি চালু করার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয়। তাদের বক্তব্য ভারতের হাতে পায়ে ধরে হলেও পুনরায় স্থলবন্দর দিয়ে ব্যবসা চালুর ব্যবস্থা করতে হবে ইউনুস সরকারকে।
জানা যায়, এই বিষয়ে ঢাকা চিঠিও দিয়েছে নয়া দিল্লিকে। কিন্তু নয়া দিল্লি কোনও চিঠির জবাব দেয়নি। এখানেই শেষ নয়, বর্তমানে আরও একটা বিষয় বাংলাদেশের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা হল ভারতে বসবাসকারী অবৈধ বামগলাদেশীদের পুশ ব্যাক। যা বিগত একমাস ধরে লাগাতার করে চলেছে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ। বাংলাদেশকে না জানিয়ে কয়েক হাজার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে সে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ভারত। কোনও আলোচনা, চিঠির ধার ধরছে না ভারত। যেটা নিয়ে বাংলাদেশ জুড়ে এখন হইচই চলছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়েছে, যে ভারত এখন কোনও কথা শুনতেই নারাজ। অপারেশন সিঁদূরের পর এমনিতেই ভারত স্পষ্ট করেছে, আর কোনও ধরণের হুমকি, ধমকি সহ্য করবে না নয়া দিল্লি। এখানেই অসহায় বোধ করছে ঢাকার কর্তারা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন যেমন পরিস্কার বলেছেন, ভারত থেকে পুশ-ইন ঠেকানো সম্ভব নয়।
মুহাম্মদ ইউনূস-সহ বাংলাদেশের তদারকি সরকারের অভ্যন্তরে থাকা লোকজন কথায় কথায় ভারত বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে চলেন এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। এটা নয়া দিল্লিও বুঝে গিয়েছে। আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রথম থেকেই বাংলাদেশকে বার বার বলে এসেছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো ইস্যুতে ব্যবস্থা নিতে, কিন্তু ইউনূস সরকার তার ছিঁটোফোঁটা করেনি। উল্টে ভারত বিদ্বেষী কাজকর্ম বাড়িয়েছে। এবার ভারতের পালা, তাই নরেন্দ্র মোদি সরকার একের পর এক ব্যবস্থা নিয়েছে। সূত্রের খবর, এবার একটি সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে ভারত। যদি বাংলাদেশ থেকে কোনও রকম অশান্তি বা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে অপারেশন সিঁদুর তো আছেই। ফলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছে বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস সরকার। কারণ, ভারত আর কোনও কথাই শুনছে না, কোনও চিঠির জবাবও দিচ্ছে না।
Discussion about this post