সমস্ত বুথ ফেরত সমীক্ষাকে নস্যাৎ করে বড় জয়ের দাবি রেখেছিল কেন্দ্রের বিজেপি বিরোধী “ইন্ডিয়া” জোট। যা নিয়ে প্রকাশ্যেই কটাক্ষ করেছিল বিজেপি নেতৃত্ব। ৪ জুন একটু একটু করে লোকসভা ভোটের ফল সামনে আসতেই দেখা গেল হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের চিত্র। বেলা যত গড়িয়েছে, ততই কপালে চিন্তার ভাঁজ বেড়েছে বিজেপির, অপরদিকে মুখের হাসি চওড়া হয়েছে বিরোধীদের। সন্ধ্যের পর দেখা গেল, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো পেলই না, এনডিএ জোটও কোনও রকমে উতরেছে। অপরদিকে ইন্ডিয়া জোট ঘাড়ের ওপর নিঃশাস ফেলছে এনডিএ জোটের। সংখ্যাতত্ত্বে খুব একটা পিছিয়ে নেই বিরোধী ইন্ডিয়া জোট। এমনকি তাঁরাও এনডিএ জোটে সিঁদ কেটে সরকার গড়ে দিতে পারে। কংগ্রেস সেই ইঙ্গিতও দিয়ে রাখলো মঙ্গলবার রাতে। অপরদিকে নরেন্দ্র মোদি মঙ্গলবার রাতে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষনেও তৃতীয়বার সরকার গঠনের কথা জানিয়ে রাখলেন। সবমিলিয়ে বলা যায়, আগামী কয়েকদিন অনেক ভাঙা গড়ার খেলা দেখতে চলেছে দেশবাসী।
উত্তরপ্রদেশের বারাণসী লোকসভা আসনে ২০১৪ সালে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ভোটে জিতেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৯ সালে ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২৪ সালে তাঁর জয়ের ব্যবধান এক ধাক্কায় কমেছে অনেকটাই। বারাণসীতে মোদি এবার জিতেছেন মাত্র ১ লক্ষ ৫২ হাজার ভোটের ব্যবধানে। সেই সঙ্গে গোটা উত্তর প্রদেশে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। মাত্র ৩৩টি লোকসভা আসন বিজেপির দখলে এসেছে এবার। সেখানে ২০১৯ সালে উত্তর প্রদেশে জিতেছিল ৬৪টি আসন। উল্লেখ্য, লোকসভা ভোটের আগেই বহু প্রতিক্ষিত রাম মন্দির অনেক ঘটা করে উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর পরই রাম মন্দির এবং ধর্মীয় মেরুকরণের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল বিজেপির প্রচারে। ভোটের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল সেটা কোনও কাজেই এল না গো বলয়ের অন্যতম বড় রাজ্যে।
কি এমন হল, যে উত্তর প্রদেশে ধরাশায়ী হতে হল বিজেপিকে। এর উত্তর হল অখিলেশ যাদবর হাত ধরে সমাজবাদী পার্টির উত্থান, এবং ইন্ডিয়া জোটে রাহুল গান্ধীর নমনীয় মনোভাব। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি যদি এবার ইন্ডিয়া জোটের ক্যাপ্টেন হন, তাহলে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ অবশ্যই অখিলেশ যাদব। এর পিছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে। অখিলেশের দল এবার উত্তর প্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ছিনিয়ে নিয়েছে ৩৭টি আসন। পাশাপাশি কংগ্রেসকে পেয়েছে ৬টি আসন। সবমিলিয়ে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে ইন্ডিয়া জোট তুলে নিয়েছে ৪৩টি আসন। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের নাগিনা আসনে একক শক্তিতে লড়ে জিতেছেন দলিত সংঘঠন ভীম আর্মির প্রধান তথা আজাদ সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ ওরফে রাবণ। সবমিলিয়ে হল ৪৪টি লোকসভা আসন। সেখানে এনডিএ জোটের দখলে এবার রাষ্ট্রীয় লোকদল দু’টি আপনা দল(এস) একটি ও বিজেপি মিলিয়ে মোট ৩৬টি লোকসভা আসন। কথায় আছে, লোকসভায় উত্তরপ্রদেশ যার, কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতা তাঁর।
সেটা পরের বিষয়, এখন প্রশ্ন হল ইন্ডিয়া জোট কেন এবার ভালো ফল হল? উত্তরে বলতে হবে লোকসভা ভোটের বহু আগেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গন্ধির ভারত জোড়ো যাত্রা। দুই দফায় তিনি ঘুরেছেন হাজার হাজার কিলোমিটার। দক্ষিনের কন্যাকুমারী থেকে উত্তরের কাশ্মীর, উত্তর-পূর্ব থেকে রাজস্থান। রাহুলের এই পথে নেমে জনসংযোগ মৃতপ্র্যায় কংগ্রেসকে বাঁচার অক্সিজেন জুগিয়েছে। ফলে ২৪-এর লোকসভায় একাই সেঞ্চুরির দোরগড়ায় কংগ্রেস, ইন্ডিয়া জোটের সর্বোচ্চ। পাশাপাশি রাহুল গন্ধি লোকসভা ভোটের আগে কর্মসংস্থান, বেকারত্ব ও কৃষকদের দুর্দশার ইস্যুগুলি নিয়ে যে জোরদার প্রচার করেছিলেন, সেটা কার্যকরী হয়েছে গ্রামীণ ও ছোট শহরগুলিতে। সেখানেই বিজেপি ধরাশায়ী। ফলে চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে নিজের ‘পাপ্পু’ ইমেজ থেকে বেরিয়ে ইন্ডিয়া জোটকে যথার্থ নেতৃত্ব দিয়েছেন রাহুল গান্ধি। আর একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি অখিলেশ যাদব। এবার উত্তর প্রদেশে তাঁর দল সমাজবাদী পার্টি একাই ৩৭টি আসন দখল করে বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই ঢেলেছে। কোন অঙ্কে এই অসাধ্য সাধন করলেন অখিলেশ? এর উত্তরে বলতে হবে, শুধুমাত্র যাদব ভোটের ওপর এবার ভরসা করেননি মুলায়ম পুত্র। তিনি এবার বিভিন্ন লোকসভার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং চাহিদা বিশ্লেষণ করেই প্রার্থী বাছাই করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাম মন্দিরের নগরী অযোধ্যা যে লোকসভার অন্তর্গত, সেই ফৈজাবাদই এবার দখল করেছে অখিলেশের দল। এখানে এবার তিনি এক ব্রাক্ষ্ণণ নেতাকে প্রার্থী করেই বাজিমাৎ করলেন। ফলে জাত, জাতি, ধর্মীয় সমীকরণ মেনে প্রার্থী দিয়েই তিনি সাফল্য পেলেন উত্তর প্রদেশে। ফলে এবারের লোকসভায় ইন্ডিয়া জোটে তিনিই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, সেটা বলাই বাহুল্য।
Discussion about this post