সাধারণত বামপন্থীদের চেনা বৃত্ত ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে ভাবা যায় না। কিন্তু কয়েকজন বামপন্থী নেতা এমন রয়েছেন, যারা সাহিত্য জগতেও অবাধ যাতায়াত করেছেন। এমনই একজন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতি করে এসেছেন। সংগঠনও সামলেছেন। কিন্তু খুব সন্তর্পণে সাহিত্য সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান তিনি রেখে গিয়েছেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও অনুবাদ সাহিত্যে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বঙ্গ রাজনীতিতে বিগত কয়েক দশক ধরে যেমন তিনি দাপটের সঙ্গে নিজের ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনই সাহিত্য জগতেও তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। বামপন্থী ঘরানা মেনে তাঁর কলমে সবসময়ই উঠে এসেছে সর্বহারা শ্রেণির কথা। কিন্তু কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতোই তাঁর লেখনীতে ছিল হালকা রোমান্টিকতার ছায়া।
ছাত্রজীবন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সিপিআইএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই তিনি জড়িত ছিলেন। সেই সময় এই সংগঠনের দলীয় পত্রিকায় লেখালেথি এবং সম্পাদনা করেছেন। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেলিন, মায়কোভস্কি হোক বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কোনও লেখকের বইই তিনি বাদ দিতেন না। তাই বইপ্রেমী বুদ্ধদেব একসময় নিজেই তুলে নেন কলম। ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশ পায় তাঁর লেখা নাটক “দুঃসময়”। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবতার জয়ের পটভূমিকায় লেখা সেই নাটক। সেই বইয়ে ছিল স্বল্পদৈর্ঘের মোট ৬টি নাটক। তবে শুধুমাত্র দুঃসময় মঞ্চস্থ হয়েছিল। রাজধর্ম নামে তাঁর লেখা আরেক নাটকে উঠে এসেছিল সন্নাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অগ্রাসী চেহারা। পরবর্তী সময়ে লেখা তাঁর লেখা আরেকটি নাটক “পোকা” যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল পাঠক সমাজে। যদিও এটি তাঁর মৌলিক রচনা ছিল না। ফ্রানৎজ কাফকা রচিত মেটামরফোসিস অবলম্বনে লেখা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনেক বিদেশী লেখকের গল্প-উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটি উপন্যাসের অনুবাদ “বিপন্ন জাহাজের নাবিক”। পাশাপাশি চিলিতে গোপনে, নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু ইত্যাদি উল্লেথযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ পুড়ে যায় জীবন নশ্বর। এছাড়া দুই খণ্ডে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার নিয়ে তাঁর লেখা “ফিরে দেখা” রয়েছে। পাশাপাশি পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল তাঁর লেখা “স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা” বইটি।
শুধু লেখালেথি নয়, নাটক, সিনেমার প্রতিও ছিল তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ। নন্দনে ভালো সিনেমা হলেই তিনি চলে যেতেন সিনেমা দেখতে। কলকাতায় বহু নাটক তিনি দর্শকাশনে বসেই দেখেছেন। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি থাকতো চোখে পড়ার মতো। শেষ জীবনেও তিনি অসুস্থতার কারণে দীর্ঘসময় বিছানায় সজ্জাসায়ী ছিলেন। কিন্তু বই পড়ার প্রতি তাঁর কোনও অনীহা ছিল না। রোজ নিয়ম করে বই পড়তেন। এমনকি চোখের সমস্যার জন্য যখন বই বা সংবাদপত্র পড়তে পারতেন না। তখন কেউ পড়ে শোনালে তিনি তা শুনতেন। মৃত্যুর পর সাহিত্যনুরাগী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই বিজ্ঞানচর্চার জন্য রেখে গেলেন তাঁর অবদান। মৃত্যুর আগেই তিনি দেহদানের অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে শুক্রবার পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দেহ তুলে দেওয়া হবে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যে মানুষটা আজীবন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কাজ করে গেলেন, মৃত্যুর পরও তাঁর দেহ নিয়ে গবেষণা করবেন মেডিকেল পড়ুয়ারা। তাঁর চোখের কর্ণিয়া আলো দেবে কোনও দুই অন্ধ মানুষকে।
Discussion about this post