স্বাধীনতা, এই শব্দটার বহুমুথী ব্যবহার রয়েছে। তবে আক্ষরিক অর্থে স্বাধীনতা শব্দের অর্থ হল, কোনও রকম বাঁধা বা সংযম ছাড়া যেমন ইচ্ছা কথা বলা। যেমন ইচ্ছা কাজ করা, পরিবর্তন করার ক্ষমতা বা অধিকার। যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাওয়া, সেটা যে কোনও সময় হতে পারে। কেউ আটকানোর থাকবে না। বলা ভালো স্বাধীনতা হল এমন স্বায়ত্বশাসন, যা নিজেকে নিজের আইন প্রদান করার মতোই। এক কথায় স্বাধীনতার বলে আমরা কারও পরাধীন থাকবো না। সেটা যেমন একটি দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনই একটি মানুষের কাছেও। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা শব্দবন্ধ ব্যবহার করা যায়। কিন্তু আজ ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসের দিন দাঁড়িয়ে আমাদের সোচ্চার হতে হয় নারী স্বাধীনতার দাবিতে। তার মানে, ব্যক্তি স্বাধীনতা শুধুই পুরুষতান্ত্রিক। এখানে নারীরা আজও পরাধীন।
১৪ আগস্ট মধ্যরাতে হাজার হাজার নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলার পথে-ঘাটে নেমেছিলেন সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু নারী স্বাধীনতা, নিরাপত্তার দাবিতে যে স্বতস্ফুর্ত আন্দোলন ঘটে গেল একরাতের মধ্যে, সেটা নিয়ে কোনও তর্ক হতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে গোটা ভারত থুড়ি গোটা বিশ্ব একক্ষনে দেখে ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গে ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে রাস্তার দখল নিয়েছিল মেয়েরা। কি অদ্ভুত সমাপতন, ১৯৪৭ সালের এই ১৪ আগস্ট মধ্যরাতেই ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। তারপর কেটে গিয়েছে ৭৭ বছর। তবুও নারীদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা নিয়ে পথে নামতে হচ্ছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মহিলাদের। শুধু শহরকেন্দ্রীক নয়, এই পথে নামা ছিল গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। এই পথে নামার জন্য কোনও রাজনৈতিক দলের ডাক ছিল না, কোনও বড় সংগঠনের হাত ছিল না। তবুও পথে নামলেন আট থেকে আশির কিশোরী, যুবতী, বৃদ্ধারা। সেই সঙ্গে ছিলেন প্রচুর পুরুষ। যাদের ঘরে বউ-বাচ্চা রয়েছে, যারা আটপৌড়ে জীবনযাপণে অভ্যস্ত। প্রতিদিন তাঁদের মেয়েরা স্কুল, কলেজ বা কাজে গেলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতে হয় তাঁদের সুস্থ শরীরে ফিরে আসার জন্য। এখানেই প্রশ্ন আসে, স্বাধীনতাটা ঠিক কাদের জন্য।
বর্তমান সময়ে মেয়েরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে কোনও ক্ষেত্রে লড়াই করছেন। পড়াশোনা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, চাকরি সব ক্ষেত্রেই। এমনকি পদাতিক, নৌসেনা এবং বিমানবাহিনীতেও মহিলাদের সক্রিয় উপস্থিতি নজর কাঁড়ে। বেসরকারি চাকরিতেও মেয়েরা এখন সমাজের উঁচু আসনে বসেছেন। এমনকি মহাকাশেও আকছাড় যাতায়াত করছেন মহিলারা। তবুও কোথাও একটা বিচ্যুতি থেকে গিয়েছে। পুরুষরুপী কয়েকজন নরপিসাচের জন্য সমাজে মহিলারা আজও আতঙ্কের রাত কাটান। শুধুই কি তাই! না, এমনটা মোটেই নয়। কথায় আছে, চ্যারিটি বিগিনস হোম। এই আপ্তবাক্য যেমন আমোঘ, তেমনই তার ব্যাপ্তি। যেমন, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে মহিলারা সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও নিজের ঘরেই অবহেলিত থাকেন। মহিলা মাত্রই সংসার করবেন, সন্তান প্রতিপালন করবেন, বয়স্কদের আদর-যত্ন করবেন, এটাই যেন দস্তুর হয়ে রয়েছে। সে তিনি যতই উঁচু পদে কর্মরত থাকুন না কেন। যেমন, আর জি কর মেডিকেল কলেজের মহিলা চিকিৎসকের ঘটনাই ধরুন। তাঁকে কেন মরতে হল? পুলিশের প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরের প্রশ্ন আসে, উনি তো কাজে ছিলেন, তাহলে তাঁর নিরাপত্তা ছিল না কেন? আর জি কর হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সেই সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ওই মহিলা চিকিৎসক সেমিনার হলের কক্ষে গভীর রাতে কেন একা ছিলেন? এখানেই লুকিয়ে রয়েছে নারী স্বাধীনতার নকল দম্ভ। এখানেই লুকিয়ে রয়েছে নারী স্বাধীনতার নকল দম্ভ। একজন পুরুষ রাতে একা কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত, কিন্তু নারীরা নয়। এমনটাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন আর জি কর হাসপাতালের অপসৃত অধ্যক্ষ। তাই স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরও নারীদের নিজেদের সুরক্ষা, অধিকার এবং স্বাধীনতার দাবিতে পথে নামতে হয়।
Discussion about this post