স্বৈরাচারি তকমা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। সেই সঙ্গে স্বৈরাচারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রতিনিয়ত দেগে চলেছে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার একটা বড় অংশ। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, পরে তাঁদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর ফিরতে দেওয়া হবে না বলে “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” পণ করেছে। যা নিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও মরণপন লড়াই করতে প্রস্তুত। এই আবহে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ঠিক কি ভাবছে, তাঁরা কি আদৌ বাংলাদেশে নতুন রূপে আসবে? নাকি সেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ফিরে আসার প্রচেষ্টায় আছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ নিয়ে এখন যে সমস্ত চর্চার বিষয় রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম এই বিষয়টি।
একটা বিষয় পরিস্কার, বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্দরে শেখ হাসিনা এখনও একটা আতঙ্কের নাম। কারণ এই সরকারের চালিকা শক্তি জামায়তে ইসলামী এবং হিজবুত তেহরীর মতো কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলি কোনও মতেই চায় না যে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা ফিরে আসুক। তাঁরা তো এমন পরিকল্পনাই করেছিল যে গত ৫ আগস্ট গণভবনের সামনে হাসিনাকে হত্যা করতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কেউ সেটা হতে দেননি, ফলে সেফ প্যাসেজ পেয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে আসতে পারেন। হাসিনা বিগত সাত মাসের বেশি সময় ধরে ভারতের কোনও এক গোপন ডেরায় রয়েছেন। সেই ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁকে আর সর্বসমক্ষে দেখাও যায়নি। তবে ইদানিং তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয়। যদিও শুধুমাত্র তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ শেখ হাসিনার অডিও ক্লিপ পাওয়া যাচ্ছে, ভিডিও ক্লিপ সামনে আসেনি। তবুও মুহাম্মদ ইউনূসের মাথাব্যাথার কারণ তিনি। কেন? সেই উত্তরই এবার খোঁজার চেষ্টা করি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথমসারির সংবাদপত্র প্রথম আলোতে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে নাকি উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের বহু নেতা। ওই অভিযোগে হাসিনা-সহ ৭৩ জন আওয়ামী নেতা ও সমর্থকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করা হয়েছে। ঘটনাটির তদন্ত চালাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি। আর সেই তদন্তে সামনে এসেছে ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ নামে একটি মঞ্চের নাম। যারা অনলাইনে একাধিক বৈঠক করছেন এবং নানা ষড়যন্ত্রের সলতে পাকাচ্ছেন। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, সে দেশের সিআইডি জানতে পেরেছে, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর অনলাইনে একটি সভা হয়। ওই সভাতেই ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ গঠন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। ওই বৈঠকে দেশ-বিদেশের প্রায় ৫৭৭ জন অংশগ্রহণকারী যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সিআইডি জানিয়েছে, তাঁদের ধারণা তদন্ত যত এগোবে এই মামলায় আরও অনেকের নাম যুক্ত হবে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, শেখ হাসিনাকে এখনও হাতে পায়নি বাংলাদেশ সরকার। ভারত সরকারকে একাধিক চিঠি দেওয়ার পরও নয়া দিল্লি হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না। এমনকি ইন্টারপোলের কাছেও হাসিনার নামে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হলে, সেখান থেকেও সাড়া মেলেনি। ফলে হাসিনার নামে আরও মামলা জুড়ে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার। এও জানা যাচ্ছে, ঈদের ছুটি মিটলেই ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে হাসিনার বিরুদ্ধে থাকা মামলার শুনানি শুরু হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের হাতিয়ার হবে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার কথায়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে একটি ব্যবস্থার কথা খুব শোনা যাচ্ছ বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কোনও এক কর্তা নাকি জাতীয় নাগরিক পার্টির কয়েকজন নেতাকে ডেকে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ সম্পর্কে জানান এবং তাঁদের এই বিষয়টি মেনে নিতে নির্দেশ দেন। যা নিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক পোস্ট এবং আসিফ মাহমুদের একটি ভিডিও বার্তায় সরাসরি সেনাবাহিনীকে টার্গেট করা হয়। হাসনাতের পোস্টে সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ফজলে নূর তাপসের মতো কয়েকজন আওয়ামী নেতার নামও উল্লেথ করেন। এরপরই বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যদিও আওয়ামী লীগ এখনও এই বিষয়ে মুখ খোলেনি, শেখ হাসিনাও সেরকম কোনও বার্তা দেননি। আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, শেখ হাসিনাসহ দলের অনেকে ভারতে আছেন। সেখান থেকে দল পুনর্গঠনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে তাতে শেখ হাসিনার ইচ্ছা ও মতামত বেশি গুরুত্ব পাবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এর বাইরে কোনো ‘সংস্কার’ বা পরিশুদ্ধির উদ্যোগ কেউ নিলে তা আত্মগোপনে থাকা নেতাদের বাধার মুখে পড়বে বলে দেশে থাকা দলটির নেতাদের অনেকে মনে করছেন। আরেকটি অংশ দাবি করছেন, হাসিনা স্বয়ং দলের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তিনি ইতিমধ্যেই দলের ১০০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে দল থেকে তাড়িয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। গোপন বৈঠকে নেত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, আগামীদিনে এই সমস্ত নেতা-নেত্রীরা আওয়ামী লীগের হয়ে মাঠে নামতে পারবেন না। ফলে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ নিয়ে যদি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান অথবা অন্য কোনও সেনাকর্তা উদ্যোগী হন, তাহলে এর পিছনে যুক্তি আছে। হাসিনা নিজেই আলাদা করে রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ নিয়ে দেশে ফিরতে চান। কারণ তিনি একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত, যে যতই জাতীয় নাগরিক পার্টি বাঁধা দিক, ভারত-সহ আন্তর্জাতিক চাপে আসন্ন নির্বাচন হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলা যাবে না। শুধু তাঁদের গায়ে সাঁটিয়ে দেওয়া স্বৈরাচারী এবং দুর্ণীতিবাজ তকমা ছেঁটে ফেলতে উদ্যোগী শেখ হাসিনা।
Discussion about this post