রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চারদিনের বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তিনি এমন একটা সময়ে বাংলাদেশ এলেন, যখন বাংলাদেশে মানবাধিকার হরণ নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ সামনে আসছে। বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশের একাধিক সংগঠন ও সংবাদ মাধ্যম সরব। আবার একই সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, ক্রিস্টান বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নিয়ে সরব ভারত। ঠিক এমন একটা সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ফলে আশা করা হয়েছিল তিনি মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকারকে এই জাতীয় মানবাধিকার সমস্যা নিয়ে প্রয়োজনীয় কড়া বার্তা দিয়ে যাবেন। কিন্তু আদতে হল উল্টো। অ্যান্তোনিও গুতেরেস মুহাম্মদ ইউনূসের শুধুই পিঠ চাপড়ে গেলেন তাই নয়, তিনি তাঁকে সবরকম সহযোগিতা করার আশ্বাসও দিয়ে গেলেন। অন্যদিকে তাঁর সফরকালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঢাকায় একটি গোলটেবিল বৈঠক করে, যাতে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে ওই বৈঠকে ডাক পায়নি আওয়ামী লীগ। সরকারিভাবে আওয়ামী লীগ এখনও বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যার দিকে জনসমর্থন ৫০ শতাংশের বেশি। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি রাষ্ট্রপুঞ্জ পক্ষপাতদুষ্ট? তাঁরাও কি পাড়ার ক্লাবের মতো আচরণ করছে?
যুক্তি-তর্ক, বিচার-বিশ্লেষণ করলে এমনটাই মনে হওয়া বাস্তব। এরজন্য পরপর কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমেই আসা যাক রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখার একটা তদন্ত রিপোর্ট প্রসঙ্গে। গত বছর ৫ আগষ্টের পর মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখার একটি তদন্তকারী দল বাংলাদেশে আসেন। তাঁরা গোটা দেশ ঘুরে, বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রিপোর্ট নিয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন। দেখা যায় ওই রিপোর্টে জুন জুলাইয়ের গণ আন্দোলনের সময়কার হিসেব-নিকেশ বেশি আর ৫ আগস্ট পরবর্তী ১০ দিনের একটা ছোটো হিসেব দেওয়া হয়েছে। ওই রিপোর্টে সরাসরি শেখ হাসিনা ও তাঁর প্রশাসনকেই দায়ী করা হয়েছে। অথচ ৫ থেকে ১৫ আগষ্টের মধ্যেকার সময়েও যে বাংলাদেশে বিপুল হারে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তা খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁরা যে হিসেব নিকেশ দিয়েছে, তাতে অনুপাতিক হার লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে চিত্রটা কত ভয়াবহ। ইউনূস সরকার যখন পরের অংশটুকু বাদ দিয়ে প্রথম অংশকে প্রাধান্য দিয়ে জোরদার প্রচার করছে তখনই বেফাঁস বলে ফেললেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখার প্রধান ভালকার টুর্ক। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেই বসলেন যে তিনি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের ওপর গুলি চালানো যাবে না। তাহলে রাষ্ট্রপুঞ্জ পিস কিপিং মিশন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে দেবে। ফলে গোটা বিশ্বেই প্রশ্ন উঠে গেল, রাষ্ট্রপুঞ্জ কি এ ধরণের নির্দেশ বা হুমকি দিতে পারে? নাকি তাঁরাও কোনও ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই বাংলাদেশ সফরে এলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি পবিত্র রমজান উপলক্ষে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরুণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নেন। এমনকি তিনি রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে একটি গোলটেবিল বৈঠকও করেন। সবশেষে এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তাঁর বাংলাদেশে আসার কারণসমূহ ব্যাখ্যা করেন। তাঁর কথায়, নতুন বাংলাদেশে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেখানে প্রধান সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত আছে জাতিসংঘ।
বাইট – অ্যান্তোনিও গুতেরেস, মহাসচিব – রাষ্ট্রপুঞ্জ
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও এই বিষয়ে উচ্ছসিত। তাঁর কথায়, এটি বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ উভয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সফল করতে সাহায্য করবে।
বাইট – তৌহিদ হোসেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা-বাংলাদেশ
সবমিলিয়ে ধরে নেওয়াই যায়, বাংলাদেশে চলমান ডাকাতি, গণধোলাই, খুন, ধর্ষণ, নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচার ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলি নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব খুশি। অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্য অনুযায়ী ধরে নেওয়াই যায়, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সবচেয়ে নিরাপদ দেশ, যেখানে কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছেই না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমেই প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে নতুন করে বামপন্থী সংগঠনগুলি এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা আন্দোলনে নেমেছে। বিভিন্ন জায়গায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি হচ্ছে। অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সফরকালেই ধর্ষণের শিকার এক আট বছরের নাবালিকার মৃত্যু নিয়ে উত্তাল গোটা বাংলাদেশ। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব এই বিষয়ে একটা কথাও বললেন না। উল্টে তাঁর মুখে মুহাম্মদ ইউনূসের বারংবার বলা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচির প্রশংসা শোনা গেল। যে সংস্কারের দোহাই দিয়ে তদারকি সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছে নির্বাচন বিলম্বিত করে। ফলে অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সমর্থন পেয়ে তদারকি সরকার ও জাতীয় নাগরিক পার্টি এখন নতুন করে সংস্কার প্রসঙ্গ তুলে প্রচার শুরু করেছে। মুহাম্মদ ইউনূসও ছোটো প্যাকেজ, বড় প্যাকেজ সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, সেটা হল অ্যান্তোনিও গুতেরেসের একটি গোলটেবিল বৈঠক। যেখানে তিনি বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। জানা যাচ্ছে ওই বৈঠক ডাকা হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফেই। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ওই বৈঠকে ডাকাই হল না বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে। বরং দেখা গেল হালে তৈরি হওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অথচ সেই দল এখনও বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। এটা রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো একটা সংগঠন করতে পারে কিভাবে সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ। আওয়ামী লীগের দাবি, তাঁরা অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে একটা স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা বিভিন্ন তথ্য দাখিল করে বর্তমান বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, খুন, ধর্ষণ, সংখ্যালঘু অত্যাচার, গণধোলাই-সহ নানা অপরাধের বিবরণ জমা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরে এই ধরণের ঘটনা নিয়ে একটি বাক্যও শোনা গেল না তাঁর মুথে। আসলে বর্তমানে রাষ্ট্রপুঞ্জের মুখোশ খুলে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁদের ভূমিকা নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে বহু আর্থিক সাহায্যও বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আদতে দেখা গেল তিনিই ঠিক। না হলে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে এক পক্ষ অর্থাৎ মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ নিয়েই কথা বলে গেলেন, বাদ গেল মানবাধিকার ও আওয়ামী লীগ। অনেকটা পাড়ার ক্লাবের মতোই তাঁরা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করলেন, যা রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানকে কালিমালিপ্ত করার পক্ষে যথেষ্ট।
Discussion about this post