গত সাত মার্চ ভোর রাতে মধ্য আফ্রিকা সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। কিন্তু তাঁর ফেরাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। কারণ, তাঁর মধ্য আফ্রিকা থেকে ফেরার কথা ছিল সাত মার্চ বিকেলের পর। কিন্তু তিনি তড়িঘড়ি সফরসূচি কাঁটছাঁট করে সময়ের অনেকটা আগেই ঢাকা ফেরেন। এমনকি তিনি সোজা পথে না এসে, অনেকটা ঘুরপথে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁর বিমান অবতরণ করেনি, বরং সেনা নিয়ন্ত্রিত তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাঁর বিমান নামে। এই খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হলেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলি কিছুই জানায়নি।
অপরদিকে বিভিন্ন সূত্রে মারফত পাওয়া খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্দরে একটা বিদ্রোহের আঁচ করেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান অতি সতর্কতা অবলম্বন করে জরুরিকালীন তৎপরতায় ঢাকায় ফেরেন। তারপর তিনি কয়েকটি কড়া পদক্ষেপ নেন। জানা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সেনার অন্দরে জেগে ওঠা বিদ্রোহের আঁচ তিনি নিভিয়ে ফেলেছেন। ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে, অথবা পুরোদস্তর নজরবন্দি করা হয়েছে প্রায় ১২ জন সেনাকর্তাকে। যারা বাংলাদেশ সেনার অভ্যন্তরে পাকিস্তান বা জামাতের প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করছিল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রথমেই এই খবর দিতে শুরু করলেও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম তেমন কিছু বলেনি। এমনকি বাংলাদেশের ইউটিউবাররাও এই খবরের সত্যতা স্বীকার করেননি। কিন্ত দিন কয়েক যেতেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও জোরালো হচ্ছে গুঞ্জন। সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান যে বড় কোনও পদক্ষেপ নিয়েছেন, তিনি যে বিদ্রোহী সেনাকর্তাদের গ্রেফতার করেছেন এমন তথ্যও স্বীকার করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের ইউটিউবাররা।
দাবি করা হচ্ছে, ইতিমধ্যেই ১২ জন উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাকে নজরবন্দি বা গৃহবন্দি করা হয়েছে। আরও ২৯ জন সেনাপ্রধানের টার্গেটে রয়েছেন বলেও দাবি করছেন বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিক। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, লেফটান্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসান এবং লেফটান্যান্ট জেনারেল ফইজুর রহমান। যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে জামাত বা পাকিস্তানপন্থী হিসেবে স্বীকৃত। পাশাপাশি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়াও ইতিমধ্যে নজরবন্দি হয়েছেন। লেফটান্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমানও নজরবন্দিতে রয়েছেন। এও জানানো হচ্ছে, গাজীপুরের অস্ত্র কারখানায় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল সেটাও স্থগিত করেছেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামান।
এই চুক্তির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট হয়েছিলেন লেফটান্যান্ট জেনারেল ফইজুর রহমান। তাঁরই মধ্যস্থতায় পাক সেনা কর্তা এবং আইএসআই কর্তারা গাজীপুর অস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করেছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সাভার ও মীরপুরে যে সেনাক্যাম্প রয়েছে, সেগুলির নিয়ন্ত্রণে ছিল লেফটান্যান্ট জেনারেল ফইজুর রহমানের। এখন সেগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। আরও জানা যাচ্ছে, মেজর পদমর্যাদার কয়েকজন আধিকারিক যারা এই মুহূর্তে বিদেশে কর্মরত রয়েছেন, তাঁরাও এই ষড়যন্ত্রে সামিল আছেন। জেনারেল ওয়াকার উজ জামান তাঁদেরও গ্রেফতার বা নজরবন্দি করার চেষ্টায় আছেন। ফলে বলাই যায়, যা রটে তার কিছুটা হলেও ঘটে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর সমস্ত কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এবং আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা তার ঝলক দেখতে শুরু করব।
বাংলাদেশে কিছু একটা যে হচ্ছে তার প্রমান আরও আছে। যেমন সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, “গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধ শক্তি একটি ছদ্ম-যুদ্ধ চালাচ্ছে”। সেই দীর্ঘ পোস্টে তিনি এক জায়গায় লেখেন, “সরকার যুদ্ধ লড়ছে গণ-অভ্যুত্থানে পরাজিত একটি শক্তিশালী দেশি- বিদেশী জোটের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল জনগণের মধ্যকার অভ্যুত্থানের ঐক্যকে নস্যাত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। সফল ও হচ্ছে। সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের বিভিন্ন শক্তিকে মুখোমুখী না করাই আমাদের জন্য আখেরে ভালো হবে”। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তিনি কোন যুদ্ধের ইঙ্গিত করলেন? তিনি নিজেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং সে যুদ্ধ অন্য জায়গা থেকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা কন্ট্রোল রুম থেকে সে যুদ্ধের প্রতি সপ্তাহ ও দিনের কর্মসূচি চালু করা হয় ও মনিটর করা হয়। আমাদের সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়তে হবে”।
মাহফুজ আলম, যাকে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড বলে চিহ্নিত করেছিলেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। যাকে তদারকি সরকারের উপদেষ্টা পদে এনেও দীর্ঘদিন কোনও নির্দিষ্ট দফতর দেওয়া হয়নি। সেই মাহফুজ যে যথেষ্টই প্রভাবশালী এবং কুচক্রী সেটা বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে তিনি এরকম ফেসবুক পোস্ট এমনি এমনি দেননি। ফলে ধরেই নিতে হবে তিনি বা তাঁর তদারকি সরকার কিছু একটা আঁচ করেছে। বিশেষ করে যখন তিনি বলছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং সে যুদ্ধ অন্য জায়গা থেকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে”। অর্থাৎ তাঁর ইঙ্গিতে একদিকে রয়েছে স্পষ্টতই ভারত ও আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে দেশের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন। সেটা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান নয় তো? কারণ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধানই যে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধের কথাই এবার বলছেন মাহফুজ। কিন্তু সেনাপ্রধান দেশের অরাজক পরিস্থিতির জন্য সরাসরি দায়ী করেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের। যা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারেননি মুহাম্মদ ইউনূস এবং মাহফুজরা। সেনাপ্রধান যে শুধু মুখে বলেই থেমে যাননি, সেটাও এখন পরিস্কার। আর বিদেশ থেকে বলতে মাহফুজ ভারতের মদত বা উস্কানি বলতে চেয়েছেন সেটাও পরিস্কার। ফলে দুয়ে-দুয়ে চার করে নিতে অসুবিধা কোথায়?
Discussion about this post