কোনও দেশের হাইকমিশনার কিংবা রাষ্ট্রদূতের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের তেমন একটা নজির নেই। শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর যে কোনও দেশেই এই ধরণের ঘটনা অতি বিরল। কিন্তু শুক্রবার আচমকা বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় বর্মা ঢাকা থেকে দিল্লি উড়ে এসে সাক্ষাৎ করলেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর সঙ্গে। ভারতের কূটনীতিতে এই ধরণের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা, সেটা অনেকেই মনে করতে পারছেন না। যদিও এই সাক্ষাতের কথা অবশ্য সেনাবাহিনী সরকারিভাবেই জানিয়েছে। সেনার জনসংযোগ আধিকারিক এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ভূ-কৌশলগত বিষয়ে কথা হয়েছে। সাধারণত এই ধরণের সাক্ষাৎকারের ঘটনা প্রকাশ্যে জানানো হয় না। কিন্তু ভারতের তরফে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে তা জানানো হল। এখানেই খটকা লাগছে। তাহলে বড় কোনও পরিকল্পনা করছে ভারত? এই প্রশ্নই এখন ভারতের কূটনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের চিন সফরকে ভারত যে খুব একটা সহজভাবে নেবে না এটা পরিস্কার। বিশেষ করে আগে থেকেই যখন তিস্তা নদী প্রকল্প এবং মোংলা বন্দর নিয়ে যখন ভারতের সঙ্গে একটা মৌ স্বাক্ষর হয়েছিল বাংলাদেশের। সেটা উপেক্ষা করেই মুহাম্মদ ইউনূস চিনকে খুশি করতে গিয়ে এই দুটি প্রকল্প নিয়েই চিনের সঙ্গে কথা এগিয়ে এলেন। যা মোটেই কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়। ভারতের সেনাপ্রধানরা সাধারণত আঞ্চলিক রাজনীতি, বৈদশিক রাজনীতি বা কূটনৈতিক বিষয়ে নাক গলান না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা বেশ কয়েক বার দেখলাম, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী মন্তব্য করছেন। যেমন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের ভাল যোগাযোগ রয়েছে। দু-পক্ষই একে অপরকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। আবার বেশ কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, গত বছর ৫ অগাস্ট বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের দিন তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিল। আবার তিনি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি উপদেষ্টাদের অনভিপ্রেত মন্তব্য প্রসঙ্গে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়েছেন, এমনটাও শোনা গিয়েছিল জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর মুখে। এবার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা এবং একান্ত সাক্ষাৎ করা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিশেষ করে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর অতিসক্রিয়তা ঘিরে অভ্যুত্থানের জল্পনা যখন তুঙ্গে তখন এই বৈঠক বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, ভারতীয় সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত হাইকমিশনার বিভিন্ন ভূ-কৌশলগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি দুজনের আলোচনায় উঠে এসেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগীতা ও সামরিক সহযোগীতা বৃদ্ধির বিষয়টি। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করতেও দুই দেশের সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্যোগ নিয়েও আলোকপাত হয়েছে আলোচনায়। উল্লেখ্য, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে শিথিলতা থাকা সত্বেও দীর্ঘদিন পর বঙ্গোপসাগরে দুই দেশের নৌবাহিনী যৌথ মহড়া দিয়েছে। কিন্তু এই বিষয়েই যদি ভারতের সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের আলোচনা হয়, তাহলে তা এক্স হ্যান্ডলে প্রচার করা কেন হবে? এই কৌশলগত অবস্থান নিয়েই চলছে আলোচনা। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন, এই বৈঠক গভীর তাৎপর্য বহন করছে। বিশেষ করে যখন চিন সফর শেষ করে দেশে ফিরছেন মুহাম্মদ ইউনূস। কূটনৈতিক মহলের একটা অংশ মনে করছেন, বাংলাদেশে এখনও সেনা অভ্যুত্থানের বা নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই গিয়েছে। হয়তো বড় কোনও গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। যেমন এর ইঙ্গিত বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান আগেই দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হলে ভারতীয় সেনার সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে দু’জনের কথা হয়ে থাকতে পারে বলে কোনও কোনও মহলের ধারণা। তবে ভারত যে ভিতর ভিতর বাংলাদেশের জন্য বড় কোনও পরিকল্পনা করছে, এটা তারই ইঙ্গিত।
Discussion about this post