গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তারপর থেকে কবে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন হবে সেই নিয়ে বহু আলাপ আলোচনা হয়েছে। কোনও সময় এমনও মনে করা হয়েছিল, যে আদৌ নির্বাচন করাতে ইচ্ছুক নন মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর সহযোগীরা। তাঁরা নানা ফন্দি-ফিকির করে বারবার নির্বাচনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বিশেষ করে বহুমুখী সংস্কার এবং হাসিনা-সহ আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের বিচার নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত রয়েছেন। নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলেই মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কারের কথা বলে এড়িয়ে যেতেন। এতে সবচেয়ে বিরক্ত হচ্ছিল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি। তাঁরা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে চাপ বাড়াতে শুরু করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করানোর একটা নির্দেশই দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে চাপ বাড়ছিল ইউনূস সরকারের উপর।
কিন্তু একটা সফল চালে খেলা আপাতত ঘুরিয়ে দিয়েছেন নিজেকে “আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়” হিসেবে দাবি করা মুহাম্মদ ইউনূস। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন, এবং সেখান থেকেই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের পবিত্র রমজান মাসের আগে বা ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। তবে তিনি একটি শর্তও রাখেন, যদি ওই সময়ের মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন হয় তো। আর এতেই আনন্দে আটখানা হয়ে বিএনপি এখন মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু আদৌ কি ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবে? নাকি সেই নির্বাচন জুন বা তার পরবর্তী সময়েই হবে ইউনূসের পূর্বের বক্তব্য অনুযায়ী। এই আশঙ্কা কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে উঁকি দিচ্ছে, সেটা হল আওয়ামী লীগকি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠকের পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে নানান আলোচনা শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নজর এবার বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে। জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিকরা বাংলাদেশের উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে জানার-বোঝার চেষ্টা করছেন আসন্ন নির্বাচনের সঠিক সময় এবং ধরণ সম্পর্কে। আসলে বিদেশি কূটনীতিকেরা আগামী নির্বাচনের সময়, ভোটের প্রকৃতি এবং ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের ধরন ও নীতিমালা সম্পর্কে আগাম খোঁজখবর শুরু করে দিয়েছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের তরফে কূটনৈতিক মিশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিরা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উপদেষ্টা ও আমলা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। আবার কিছু দেশ ও সংস্থা শুধু স্থানীয় মিশনের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে পরিস্থিতি আগাম ও ঠিকঠাক বুঝতে আগে ঢাকায় কাজ করে যাওয়া ব্যক্তিদের পাঠাচ্ছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচনই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, বিদেশি রাষ্ট্রগুলি কি আওয়ামী লীগের পক্ষে রায় দেবে? বাংলাদেশের সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি যেমন আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সরকারের ওপর বরাবর চাপ সৃষ্টি করছিল। তেমনই জামাত ও বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে অরাজি ছিল। তবে তাঁরা চাইছিলেন আওয়ামী লীগের ওপর কিছু আংশিক নিষেধাজ্ঞা চাপুক। কিন্তু আদতে দেখা গেল মুহাম্মদ ইউনূস সরকার একদিকে যেমন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করেছেন, তেমনই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধনও বাতিল করেছেন। আবার লন্ডনে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেছিলেন, তাঁর সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেনি, কিন্তু তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা তা ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন। এতেই বিভ্রান্তি বেড়েছে। ইউনূসের কথা ধরলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কোনও সংগঠন নয়। আবার নির্বাচন কমিশন তাঁদের নিবন্ধন বাতিল করায় তাঁরা নির্বাচনেই অংশ নিতে পারবে না। পরবর্তী সময় বাংলাদেশে ফিরে ইউনূস আবার দাবি করেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়াই অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন হতে পারে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বিদেশি রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা, বাস্তবমুখী নীতি এবং তার ধারাবাহিকতা চান। তাই তাঁরা নির্বাচন কেমন হতে পারে, তা বুঝতে চাইছেন। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছর প্রায় সব পর্যায়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তবে তিনি চিনের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মশৃণ রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চিন-সহ সকলের ভাবনা প্রায় একই রকম। চিন্তার ধরনে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ভারতও এদের সঙ্গে আছে। ফলে আওয়ামী লীগকে নিয়ে ইউনূস সরকারকে তাঁদের ভাবনার পরিবর্তন করতেই হবে আগামীদিনে। যা শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের জন্য আশার আলোই বটে।
Discussion about this post