বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি যে ভারতের নজর এড়ায়নি তা নয়। তবুও ভারত ইউনুসকে ভারতে আসার অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা চিন সফরে যাওয়ার আগে নাকি ভারতে আসতে চেয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। এই আবেদন জানিয়ে ঢাকা চিঠি দিয়েছিল নয়া দিল্লিকে। কিন্তু ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সেই বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। এমন দাবি করেছিলেন বাংলাদেশের প্রেস সচিব স্বয়ং। যা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে যথেষ্টই হইচই শুরু হয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূসের চিন সফর যে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে সেটাও জানা, তাও ভারত এই বিষয়ে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। তাহলে কি ভারত আর বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? মুহাম্মদ ইউনূস চিনে গিয়ে দেখা করেছেন চিনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিনের সঙ্গে। একাধিক চিনা মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জানা যাচ্ছে, মুহাম্মদ ইউনূস চিনের সঙ্গে একটি চুক্তি ও আটটি মৌ স্বাক্ষর করে ফিরেছেন। এমনকি তিস্তা নদী মহাপ্রকল্প নিয়েও চিনকে বড় প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন তিনি। যা ভারতের কাছে আশঙ্কার বিষয় বৈকি। তবুও কেন নীরব ভারত?
কূটনৈতিক মহলের মতে, মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটা সময় চিন সফর করলেন যখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট। তাঁদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগ ও নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা, সীমান্ত হত্যা এবং গঙ্গা ও তিস্তা নদীর জলের হিস্যা না পাওয়ার কারণে জনমনে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দিন দিন বেড়ে চলছে। এই পরিস্থিতিতে ইউনূসের চিন সফরের আগেই ঢাকায় চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছিলেন, এই সফর সফল করার জন্য চিন প্রস্তুতি নিয়েছে। কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেল চিন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে বাড়তি গুরুত্ব দিলেন। বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র প্রথম আলোর দাবি, প্রধান উপদেষ্টার সফরে চিন বাংলাদেশকে ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কার্যত ভেঙে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যা এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। সেই সঙ্গে চিনা ঋণের ফাঁদে পা দিয়ে ইউনূস কার্যত যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেললেন, সেটাও দাবি করছে একটা অংশ। এবার জেনে নেওয়া যাক, চিন থেকে বাংলাদেশ কি কি পেল।
প্রথম আলো জানাচ্ছে, চিনের প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চিনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। পাশাপাশি, মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান, চট্টগ্রামে চিনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫ কোটি ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫ কোটি ডলার বরাদ্দ প্রদানের পরিকল্পনা করেছে শি জিংপিনের প্রশাসন। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে। সেই সঙ্গে চিন বাংলাদেশকে তাঁদের উচ্চাকাঙ্খি প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্পের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরে দুই দেশের প্রতিনিধিরা অর্থনৈতিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে সহযোগিতার একটি চুক্তি এবং সাস্কৃতিক আদানপ্রদান, সংবাদ মাধ্যম, খেলাধুলো ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার ৮টি মৌ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বিশ্বের বহু দেশ এর আগে চিনের মহাজনী ঋণ ব্যবসার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। যেমন, মলদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ইত্যাদি। এবার বাংলাদেশও সেই ফাঁদে পা দিল। বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিনা ঋণ নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা পূর্ববর্তী হাসিনা সরকারকে সতর্ক করলেও তাঁরা বেজিংয়ের কাছ থেকে ঢালাও ঋণ নিয়ে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুদানের অর্থও ঋণ খাতে যোগ করে দিয়েছে চিন। এবার বাধ্য হয়েই সেই সুদের হার কমাতে দরবার করতে হচ্ছে ইউনূসকে। তবুও চিনা ঋণ পেতে আবদার করছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
ভারতের সমস্যা হতে পারে, মোংলা বন্দর হাতছাড়া হলে। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সমস্যা তৈরি হবে মোংলা বন্দর চিনের হাতে চলে গেলে। কারণ বঙ্গোপসাগরে চিনের প্রভাব আরও বাড়বে। চিন কার্যত মরিয়া এই বন্দরের দখল নিজের হাতে নিতে। কারণ মিয়ানমার ও পাকিস্তানে চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ মুখ থুবড়ে পড়েছে। মিয়ানমারের কুইপেই বন্দরে আরাকান আর্মি বিপুল বোমা বর্ষণ করেছে বলেই খবর, অন্যদিকে পাকিস্তানের গয়াদার বন্দর হয়ে আসা মূল সড়ক এখন বালুচ লিবারেশন আর্মির দখলে। ফলে ওই বন্দর থেকে পণ্য আদানপ্রদান বন্ধ রাখতে হয়েছে চিনকে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা চিনকে উৎসাহিত করেছেন বঙ্গোপসাগরের টোপ দিয়ে। উল্লেখ্য, চিনে গিয়েও মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে মৃদু ভাষায় হুমকি দিয়ে চিনা বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগরের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
বাইট – মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা-বাংলাদেশ
এখন দেখার, এটাই তাঁর কাল হয়ে না দাঁড়ায়। কারণ, একদিকে মোংলা, অন্যদিকে লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি নিয়ে বাংলাদেশ যদি চিনের দিকে বেশি ঝোঁকে, তাহলে ভারত যে ছেড়ে কথা বলবে না, এটা বলাই বাহুল্য। আর এর জন্য ভারত পাশে পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও। ফলে অতিরিক্ত চিন প্রীতি আবার মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য বিড়ম্বনা হয়ে না দাঁড়ায়। সেটাও ভাবতে হবে বাংলাদেশকে।
Discussion about this post