উন্নয়ন না গণতন্ত্র? সংস্কার না নির্বাচন? হাসিনার আমল হোক বা ইউনূসের আমল, এই ধরণের প্রশ্ন নিয়েই চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে চলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কেউ কোথাও আলোচনা করছে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। যিনি আবার বিশ্বশান্তির জন্য নোবেল পেয়েছিলেন। সেই ব্যাক্তির হাতে বাংলাদেশের শাসনভার তুলে দেওয়ার পর সাধারণ বাংলাদেশিরা ভেবেছিলেন এবার হয়তো সোনার বাংলা তৈরি হবে। কারণ তাঁদের বোঝানো হয়েছিল শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে বেহাল হয়ে পড়েছে। কিন্তু হাসিনা সরকারের দাবি ছিল উল্টো। তাঁদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল দেশের দিকে পা বাড়াচ্ছে। ৫ আগস্টের পর ভারত থেকে দেওয়া ভার্চুয়াল ভাষণেও শেখ হাসিনা দাবি করেছিলেন, আওয়ামী লীগের আমলেই বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং পোশাক শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০০৯ সালে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন সেখানে বার্ষিক অর্থনৈতিক উন্নতির হার ছিল ৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে তা প্রায় ৮ শতাংশে পৌঁছয়। হাসিনার আরও দাবি ছিল, ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে উন্নীত করে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে মর্যাদা দেয় বিশ্ব ব্যাঙ্ক। ২০২৩ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক বাংলাদেশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ইউনূসের দাবি, হাসিনার সময়ে দেশের অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি নিয়ে যা বলা হতো, তা ছিল ‘ভুয়ো’।
এবার আলোচনা করা যাক, যদি সেই দাবি ‘ভুয়ো’ হয় তবে বিগত আট মাসে বাংলাদেশে কতটা আর্থিক বিকাশ হল? বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, বাংলাদেশের তদারকি সরকারের আমলে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪.১ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ৮ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে বাংলাদেশের আর্থিক বিকাশ। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের তদারকি সরকারের উচিৎ দ্রুত একাধিক পদক্ষেপ করা। এমনই পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যঙ্কের কর্তারা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রায় এক ডজনের বেশি ব্যাঙ্ক আর্থিক মন্দায় ভুগছে। তা মূলত সৃষ্টি হয়েছে ঋণ খেলাপির জেরেই। ২০২৪ আর্থিক বছরের শেষে পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাঙ্কিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এই ঋণের সিংহভাগই নেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ২০২৪ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রেকর্ড ছাড়িয়ে ৬৭ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা হয়েছে। যা ওই ব্যাঙ্কের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭২ শতাংশ। আবার জনতা ব্যাঙ্কের খেলাপি ঋণের পরিমান এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৮৪ শতাংশ। বাংলাদেশি মিডিয়ার দাবি, অ্যানটেক্স, ক্রিসেন্ট, বেক্সিমকো, থার্মেক্স ও এস আলম গ্রুপসহ নানা প্রতিষ্ঠানের একের পর এক কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়মের কারণে ব্যাঙ্কগুলি ধুঁকতে শুরু করেছে। যদিও ইউনূস সরকারের দাবি, বিগত সরকারের দুর্নীতির জন্যই এই হাল। কারণ, এই সংস্থাগুলি আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গত আগস্টে নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর কতটা উন্নতির চেষ্টা করছে?
বাংলাদেশের লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অরাজক পরিবেশের জেরে বন্ধ হয়েছে একের পর এক কল-কারখানা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সে দেশের রেডিমেড পোশাক শিল্প। হাসিনার আমলে ব্যপক দুর্নীতি এবং সিন্ডিকেট রাজ দেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ করেছে বলেই দাবি করছেন অর্থনীতিবিদরা। কেউ কেউ আবার তথ্য কারসাজির অভিযোগও আনছেন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি, শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। কিন্তু প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস কেন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পারছেন না? উত্তর হল তিনি আসলে রাজনীতিতেই বেশি মন দিয়েছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের বদলে। শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগকে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করতেই বেশি মনযোগী ইউনূস প্রশাসন। সেই সঙ্গে ক্রমাগত জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধি, মব কালচার, চুরি, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজি, তোলাবাজির জেরে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত ভারত বিরোধীতা করতে গিয়ে ডুবছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় প্রায় ২০০০ কোটির ধাক্কা লেগেছে, আবার বাংলাদেশ ভারত থেকে তুলা আমদানি স্থগিত করায় আরও বড় ধাক্কা খাচ্ছে সে দেশের পোশাক শিল্প। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে হু হু করে। এবার যা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। আসলে অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস রাজনীতিতেই মন দিয়েছেন, অর্থনীতিতে নয়।
Discussion about this post