বাংলাদেশের সীমান্ত কার্যত প্রবল ঝুঁকিতে। মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মি মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের এলাকায় ঢুকে পড়ছে। আবার মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মানবিক করিডোর দেওয়ার যে পরিকল্পনা মুহাম্মদ ইউনূস সরকার নিয়েছে, তাতে বেজায় চটেছে জুন্টা সামরিক শাসকরা। ফলে যে কোনও সময় আসতে পারে প্রত্যাঘাত। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়েছে। যার মোকাবিলা করতে রাস্তায় রয়েছে সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ। ফলে সীমান্ত সংঘাত এড়ানোর মতো বাহিনী কম হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তিন বাহিনীর প্রধানরা একযোগে হজ যাত্রা করতে যাচ্ছিলেন। এমন খবরে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। জানা যাচ্ছে, ২ জুন হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করার কথা ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধানসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট জেনারেলের। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিন বাহিনীর প্রধান এখনও বিমান ধরেননি। খুব সম্ভবত, তাঁরা তাঁদের হজ যাত্রা আপাতত স্থগিত করেছেন। বিতর্কের জেরেই এই সিদ্ধান্ত নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে সেটা অবশ্য জানা যায়নি।
বিগত কয়েকমাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের সম্পর্ক ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করানোর যে নির্দেশ জেনারেল ওয়াকার দিয়েছেন, সেটা ভালোভাবে নেননি মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মানবিক করিডোর দেওয়া নিয়েও সাফ না করে দিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার। এটাও মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রবল চাপের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, জেনারেল ওয়াকারকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় নিজেদের পছন্দের লোককে বসাতে এর আগেও উদ্যোগী হয়েছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি মার্কিন নাগরিক ডঃ খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করে সেনাবাহিনীর মাথার ওপর বসিয়ে দিয়েছেন। ফলে সেনাপ্রধান বেজায় ক্ষাপ্পা। রাখাইন মানবিক করিডোর দেওয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে সেনাক্যাম্প তৈরির পথ করে দেওয়ার নেপথ্যে এই খলিলুর রহমান রয়েছেন এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। এর আগে সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের মার্কিন সফর বাতিল করেছিল ইউনূস প্রশাসন। তারপর সিঙ্গাপুরে এক প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সেমিনারে সেনাপ্রধানের পরিবর্তে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সবমিলিয়ে এখন দুজনের দ্বন্দ্ব খুবই পরিস্কার।
এই পরিস্থিতিতে সেনাকর্তাদের সদলবলে হজ করতে যাওয়া, খুবই উদ্বেগজনক বলেই মনে করছিলেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। এক এক্স পোস্টে প্রথমে দাবি করা হয়েছিল, “সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান-সহ ৯ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা একসঙ্গে হজে যাচ্ছেন। এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।” এই খবর রটে যাওয়ার পরই বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয় বিতর্ক। বিশেষ করে যখন মিয়ানমার সীমান্তে মানবিক করিডোর নিয়ে নানা ধরণের গুজব চলছে। মিয়ানমারের দিক থেকে ক্রমাগত হুমকি আসছে। আরাকান আর্মিও মাঝেমধ্যে অনুপ্রবেশ চালাচ্ছে। আবার ভারতের দিক থেকেও সেনা সমাবেশ করা হয়েছে বাংলাদেশকে ঘিরে। এই আবহে তিন বাহিনীর প্রধান-সহ একসঙ্গে এতজন সামরিক কর্তা কিভাবে দেশ ছাড়েন, সেটা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। কেউ কেউ বলতে থাকেন, দেশের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের একযোগে অনুপস্থিতি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যখন দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সেনাবাহিনী এই বিষয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি, তবে বিডিডাইজেস্ট সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্রর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, “সামরিক নেতৃত্বের হজে অংশগ্রহণ একটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় কার্যক্রম। তবে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে কোনও ঝুঁকি এড়াতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
সূত্রের খবর, বাংলাদেশের শীর্ষ সামরিক কর্তাদের একযোগে হজ যাত্রা নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়েছে তাদের হজযাত্রা। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই হজ যাত্রা স্থগিত হল, সেটাও জানা যাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, শুধু মাত্র হজ যাত্রাই উদ্দেশ্য ছিল না জেনারেল ওয়াকার উজ জামান এবং তাঁর দুই সহকর্মীর। সৌদি আরবে কোনও গোপন বৈঠকেও উপস্থিত থাকার কথা ছিল তাঁদের। তবে এটা জল্পনার স্তরেই ছিল, কোনও সূত্রেই এটা দাবি করা হয়নি। তবুও স্থগিত করা হয়েছে তাঁদের হজ যাত্রা। জেনারেল ওয়াকার উজ জামান বাংলাদেশে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট করাতে উদ্যোগী হয়েছেন। তার জন্য সেনাবাহিনীকে তাঁর নির্দেশ আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে। সেনাপ্রধানের নির্দেশ পেয়েই বাহিনী রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাস্তায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর জারি করা হয়েছে।
মব জাস্টিসের নামে যেখানে সেখানে ভাঙুচুর ও মারধোরের ঘটনা ঘটলেই যাতে সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীকে খবর দিতে পারে, সেটার জন্যই হেল্পলাইন। কয়েকদিন আগেই জাতীয় নাগরিক পার্চির নেতা সারজিস আলমকে প্রকাশ্য রাস্তায় ধমক দিয়েছিলেন এক সেনাকর্তা। অভ্যাস মতোই তিনি গিয়েছিলেন ধড়পাকড় থামাতে। কিন্তু ওই সেনাকর্তা তাঁকে ধমক দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন। অপরদিকে, বহু জায়গা থেকেই চাঁদাবাজি বা তোলাবাজির অভিযোগ পেয়ে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের। এমন ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটছে। ফলে তিন বাহিনীর প্রধান যদি তাঁদের হজ যাত্রা স্থগিত করে দেশেই থেকে যান, সেটা হবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আগামীতে কোনও বড় পদক্ষেপের পূর্বাভাস।
Discussion about this post