বিগত দশ মাসে এই নিয়ে এগারোবার বিদেশ সফর করছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। গত মাসেই তিনি জাপান সফর করেছিলেন। সেখানেই প্রথমবার মৃদু বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল ৮৪ বছরের নোবেলজয়ীকে। তবে এবার লন্ডনে যা ঘটল, তা হয়তো তাঁর ক্যারিয়ারে কোনও দিন ঘটেনি। লন্ডনে পৌঁছনোর পর তাঁর হোটেলের সামনে যে শুধু নজিরবিহীন বিক্ষোভ হল তাই নয়, সেই সঙ্গে প্রশ্নের ঝড়ের মুখে পড়তে হল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসকে। তাঁর সরকারের আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ও সংবাদমাধ্যমের অধিকার হরণের মতো বিষয়ে চোখা চোখা প্রশ্নের মুখে পড়লেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়েন তিনি, যা ধরা পড়ল টিভি ক্যামেরার লেন্সে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, প্রশ্নকর্তারা ছিলেন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক।
বুধবার ব্রিটেনের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের রয়্যাল ইন্সটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে একজন প্রশ্ন করেন, ‘আপনি এপ্রিলের শুরুতে নির্বাচন করবেন বলেছেন, যা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। সেনাবাহিনী ও বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। আপনি আওয়ামী লিগকে ভোটে অংশ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছেন। ফলে অনেকেই বলছেন, ভোট অবাধ হবে না। এই প্রশ্নের জবাবে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে যান মুহাম্মদ ইউনূস। তবে প্রসঙ্গ এড়িয়েই তিনি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। তাঁর দাবি, মানুষ ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন। বিশেষ করে বিগত দেড় দশক যারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেননি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চ্যাথাম হাউসের মতো প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দেশের জনগণকেই প্রকাশ্যে অপমান করলেন। বাংলাদেশের শিড়ায় শিড়ায় যে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, সেটাই বিশ্বমঞ্চে বলে এলেন মুহাম্মদ ইউনূস। যা নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের প্রসঙ্গও ওঠে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল, আমি বলেছিলাম যে আপনারা হাসিনাকে আশ্রয় দিকে চান, আমি আপনাদের নীতি ত্যাগ করতে জোর করতে পারি না…কিন্তু প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন, হাসিনা যেভাবে বাংলাদেশি মানুষদের সঙ্গে কথা বলছে, তা যেন রাখতে না পারে। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, এটা সোশ্যাল মিডিয়া, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এই সময় কার্যত ক্ষোভ উগরে দিয়েই ইউনূস বলেন, কী বলব? এটা উত্তপ্ত পরিস্থিতি, শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বলে বিষয়টি এড়ানো যায় না।
চ্যাথাম হাউসের সাক্ষাৎকারের বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার মাঝেই নতুন সমস্যায় পড়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর সঙ্গে এখনও দেখা করতে রাজি হননি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার। স্বয়ং ইউনূসকেই উদ্ধৃত করে এ কথা জানিয়েছে ব্রিটেনের সংবাদপত্র ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’। চার দিনের ব্রিটেন সফরে ইউনূসের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে কোটি কোটি টাকা পাচারের যে অভিযোগ আছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে সেই টাকা দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করেছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধান। কিন্তু কিয়ের স্টারমার এখনও সেই সাক্ষাতে রাজি হননি বলেই ফিনান্সিয়াল টাইম্স-কে জানিয়েছেন ইউনূস। অন্যদিকে, ফিনান্সিয়াল টাইম্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্রিটেন সরকারের তরফেও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, এখনই ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার কোনও পরিকল্পনা নেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এটাও একটা বড় ধাক্কা মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য। কারণ, ব্রিটেন সফরের আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বড় মুখ করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় সফরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করবেন। কিন্তু এই সফরে তিনি লন্ডন বিমানবন্দরে নামার পর কোনও ব্রিটিশ কর্তা তাঁকে স্বাগত জানাতে আসেননি। এমনকি তাঁর সঙ্গে সরকারিভাবে কোনও মন্ত্রী বা সচিবও বৈঠক করেননি এখনও পর্যন্ত। এবার স্বয়ং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও সরাসরি না করে দিয়েছেন বৈঠক করার জন্য। সবমিলিয়ে প্রবল চাপ নিয়ে ইউনূস কার্যত শূন্যহাতেই দেশে ফিরবেন। এখন দেখার তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়।
Discussion about this post