গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি এক গণঅভ্যুত্থানের জেরে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান স্বতঃপ্রণোদিত ছিল কিনা, সেটা গভীর কোনও ষড়যন্ত্র ছিল কিনা, সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে প্রায় দশ-এগারো মাস ধরেই। তবে এতদিনে এটা বোঝা গিয়েছে, ষড়যন্ত্র একটা ছিল মার্কিন ডিপ স্টেটের। আর তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের মসনদে এসে বসেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ তথা শান্তির নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছে। এবার সেই মামলায় শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হয়ে আইনজীবী নিয়োগ করল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। রাষ্ট্রনিযুক্ত সেই আইনজীবী হলেন অ্যাডভোকেট আমিনুল গণি টিটো। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
হাসিনা এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলায় মূলত পাঁচটি অভিযোগ। প্রথমত, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ। তৃতীয়ত, গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে বিনা উষ্কানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা। চতুর্থত, গত বছর ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা নির্দেশ দেওয়া। পঞ্চমত, ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো ও অত্যাচার করা। এই ঘটনায় ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে এবং একজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাও রয়েছে।
সমস্যা হল যেহেতু শেখ হাসিনা দেশছাড়া, সেহেতু তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি বাংলাদেশের পুলিশ। হাসিনা ছাড়াও এই সমস্ত মামলাতে আরও দুজন অভিযুক্ত। তাঁরা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরমধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এখন কারাগারে, বাকি দুজন পলাতক। এবার তাঁদের হয়ে আদালতে লড়বেন আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো। যিনি আবার তীব্র হাসিনা বিরোধী মনোভাবাপন্ন বলেই পরিচিত। ফলে তাঁর সাওয়াল-জবাবের ওপর স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে। এমনিতেই শেখ হাসিনাকে যে কোনও মূল্যে অপদস্থ করতে উঠেপড়ে লেগেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলাদেশের আইনজ্ঞদের মধ্যে একটা অংশ দাবি করছেন, বাংলাদেশে এখন বিচারের নামে প্রহসন হচ্ছে। চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভুর মামলা যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তাই হতে চলেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সরকার পক্ষের আইনজীবী হলেন, চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মূলত তিনিই এখন বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা পরিচালনা করেন। আবার বলা হয়, হাসিনা সংক্রান্ত মামলায় তিনিই সর্বেসর্বা। ফলে শেখ হাসিনার হয়ে যিনি লড়বেন, তিনি যে কোনও মতেই আওয়ামী পন্থী হবেন না, এটা বলাই বাহুল্য। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী পন্থী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে তাঁদের কার্যত অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, হুমকি ও ভাঙচুরের ভয়ে অনেকেই এখন আদালতের ধারেকাছে ঘেঁষেন না। সেই সুযোগেই হাসিনাবিরোধী একজন আইনজীবীকেই বেছে নেওয়া হয়েছে তাঁরই হয়ে লড়ার জন্য। এটা কার্যত বিচারের নামে প্রহসনই হবে।
বাংলাদেশের আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, এই বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেউ কেউ এটাকে ‘পলিটিক্যাল ট্রাইব্যুনাল’ বলছেন। যেমন, সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডয়েচে ভেলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই বিচার তো প্রচলিত কোনো আইনের বিধানের দ্বারা হচ্ছে না। এই বিচার তো স্বাভাবিক না, অস্বাভাবিক। এই আইনটা করা হয়েছিল একাত্তরের জন্য। এখন ২০২৪ সালে এই আইনে বিচার হচ্ছে। ভবিষ্যতে তো যারা ২০২৫ বা ২০২৬ সালে থাকবে, তাদের বেলাও হতে পারে। অর্থাৎ, তাঁর দাবি, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত এই ট্রাইবুনালে সাম্প্রতিক মামলা দায়ের হচ্ছে এবং বিচার হচ্ছে। এই ধারা বজায় থাকলে, আগামীদিনে যেই ক্ষমতায় আসুক তাঁরা এই ট্রাইবুনালকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেই পারে। যা এখন করা হচ্ছে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে।
Discussion about this post