“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ কার্যত এখন এই গানের কথাই স্মরণ করছেন আপন মনে। গত বছরের জুন-জুলাই মাস থেকে গোটা বাংলাদেশ কার্যত কেঁপে উঠেছিল এক প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ক্রমে তা পরিণত হয় শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে। দাবি এক দফা এক স্লোগানে রাস্তায় নেমে আসেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁদের একটাই দাবি, স্বৈরাচারী শাসক হাসিনার পতন। গত বছরের ৫ আগস্ট তথাকথিত স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার পতন হল, এবং বাংলাদেশের মানুষ খুশিতে নেচে উঠলেন। সেই খুশি আরও চারগুণ হল যখন তাঁরা শুনলেন প্রখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নিতে সুদূর প্যারিস থেকে উড়ে আসছেন। তিনি এলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে বসলেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের সেই আনন্দ খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। কারণ, দিন দিন বাংলাদেশ পরিণত হল এক বিশৃঙ্খল ও আইনের শাসনের বাইরের এক স্বর্গরাজ্যে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলল। আন্দোলন, অবরোধ ও বিশৃঙ্খলার জেরে বন্ধ হয়ে গেল একের পর এক কল-কারখানা। বেকার হয়ে গেলেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশ ক্রমেই তলিয়ে গেল। এ ভাবে সাত মাস পেরিয়ে এল বাংলাদেশ। দেখা গেল, শেখ হাসিনার আমলেই ভালে ছিলেন বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকরা। ফলে এখন আক্ষেপ, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সাত মাস কেটে গেলেও শেখ হাসিনাই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। গত ৫ আগস্টে ঢাকা থেকে কোনও মতে পালিয়ে ভারতে চলে আসার পর থেকে কয়েকমাস তিনি কার্যত গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর কোনও হদিস ছিল না। ফলে তাঁকে নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা চলছিল বাংলাদেশে। তিনি আদৌ ভারতে রয়েছেন কিনা, তাঁর শারীরিক অবস্থা ঠিক আছে কিনা, বা তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। এরপর তাঁকে আদৌ ভারত সরকার পাকাপাকি আশ্রয় দেবে নাকি তাঁকে অন্য কোনও দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। অথবা মুহাম্মদ ইউনূসের উপদেষ্টারা সেই সময় বারবার দাবি তুলছিলেন তাঁকে যে কোনও মূল্যে ভারত থেকে ফেরত আনা হবে এবং বিচার করা হবে। হাসিনার বিরুদ্ধে একে একে শতাধিক মামলা দায়ের হল। এরমধ্যে বেশিরভাগই হত্যা, গুপ্তহত্যা, গণহত্যা, গুম, অপহরণ বা আর্থিক দুর্নীতির মতো মারাত্মক অপরাধের। ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হল।
বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বপ্নেই বিভোর থাকলেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিচার হবে। কিন্তু যত দিন গেল বোঝা গেল বাস্তবটা সম্পূর্ণ আলাদা। মুহাম্মদ ইউনূসকে তাঁরা মসীহা ভেবেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ বানাবেন ইউনূস সাহেব এবং তরুণ ছাত্রনেতারা। কিন্তু উল্টে বাংলাদেশ অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল। প্রকাশ্য রাস্তায় মব জাস্টিসের নামে গণধোলাই, মারধোর, ছিনতাই ও ডাকাতি হতে শুরু করল। শিশু ও মহিলাদের উপর নির্যাতন, যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বাড়তে লাগলো। চাঁদাবাজি, তোলাবাজি আরও দ্বিগুণ হল। কালক্রমে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা নিয়েই সংশয় তৈরি হল। আর সেই ব্যর্থতা ঢাকতে ফের উপদেষ্টাগণ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা শেখ হাসিনাকেই দায়ী করে প্রচার শুরু করলেন। ফলে আবারও শেখ হাসিনা চর্চায় চলে এলেন। ততদিনে বাংলাদেশের জনগণ অনেকটাই সরকার বিরোধী হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ উঠে আসে। এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ভয়ানক সব অপরাধের প্রসঙ্গ ওঠে না, বরং তাঁর আমলে সরকারের ভালো দিকগুলো নিয়েই আলোচনা চলতে থাকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। সাত মাস পর তিনি মুখ ফুটে তদারকি সরকারের বিরোধীতা করলেন। সরকারের উপদেষ্টাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলিকেও একহাত নিলেন প্রকাশ্য এক অনুষ্ঠানে। ফলে আগুনে ঘি পড়ল। বাংলাদেশের জনগণও বুঝলেন, কোন আমলে তাঁরা ভালো ছিলেন, এবং কোন আমলে তাঁদের বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে ইসলামী মৌলবাদীদের দখলে চলে যাচ্ছে। ইউনূস সরকার আসার পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর যে প্রবল অত্যাচার, হামলার ঘটনা ঘটছিল, কালক্রমে তা হতদরিদ্র সাধারণ মানুষের উপরেও এসে পড়ল। অপরাধীরা এখন ঢাকা-সহ বাংলাদেশের যে কোনও শহর-প্রান্তে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তৌহিদী জনতার নামে একদল দুস্কৃতী রাস্তাঘাটে যখন তখন সবক শেখায় সাধারণ মানুষকে। ফলে একদিকে শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করার দুঃখ ও যন্ত্রণা যেমন উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। তেমনই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের সাহসিক কর্মকাণ্ডকেও বাহবা দিতে শুরু করেছেন তাঁরা। বাংলাদেশের জনতার এখন একটাই আশা, সেনাপ্রধান যদি ফের একবার হাসিনাকে দেশে ফিরেয়ে আনতে পারেন। তবেই তাঁরা নতুন করে বাঁচার আশা পাবেন।
Discussion about this post