গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে হয়েছিল রাজনৈতিক পালাবদল। দেখতে দেখতে বছর ঘুরতে চলল। ২০২৫ সালের জুন মাসও শেষ পথে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবার বড়সড় সেলিব্রেশনের আয়োজন শুরু করে দিল। চলতি বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শুক্রবারই ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে মূলত তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে মূল বিষয় ছিল গণঅভ্যুত্থান দিবস এবং একমাসকাল যাবৎ উৎসব পালনের কর্মসূচি। জানা যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, ৯ জন উপদেষ্টা এবং কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলা। বিশেষ সূত্রের খবর, বৈঠক শুরু হয়েছিল উফসবের মেজাজেই, কিন্তু শেষ হয় উদ্বেগ ও বিষাদের আবহে। এর কারণ, জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে যে ধরণের উৎসব পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেটা করার জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে চলে আসছে।
গত বছররে জুন-জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশের ছাত্র ও জনতার একটা বড় অংশ রাস্তায় নেমে গিয়েছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটির ব্যানারে সংগঠিত এক আন্দোলনেই পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এই আন্দোলনে পিছন থেকে সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি ও জামাতের মতো রাজনৈতিক দলও। পাশাপাশি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশও ছিল তাঁদের সমর্থনে। আবার কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলিও জামাতের নেতৃত্বে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন ও প্রচারে সামনের সারিতে ছিল। ফলে সেই আন্দোলন অচিরেই গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পতন হয় হাসিনা আমলের। তড়িঘড়ি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের সিংহভাগ নেতা-নেত্রীদের। ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনকেই এবার পালন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার মূল আয়োজক অবশ্যই জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা সেই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো অরাজনৈতিক ব্যানারে ছিল। আজ তাঁরাই রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টির মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন হল, শুক্রবারের হাই প্রোফাইল বৈঠক কেন উৎসব থেকে বিষাদে পরিণত হল? সবই ঠিক ছিল। জুলাই মাস ধরে নানা কর্মসূচি গ্রহন করা থেকে আগামী ৫ আগস্ট জাতীয় ছুটি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। পড়ে সেটা সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, এবার থেকে প্রতিবছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালিত হবে। ৫ আগস্ট ছুটি ঘোষণা করা হবে।
সূত্রের খবর, আগামী একমাস ধরে যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে একাধিক জনসভা ও মিছিল রয়েছে। আবার আগামী ৫ আগস্ট একটা মেগা কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ওই বৈঠকে উপদেষ্টাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু জানা যাচ্ছে এই ব্যাপারে কেউই খুব একটা প্রস্তাব দেননি। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, মিছিল বা জনসভায় লোক হবে তো? তাঁদের অভিযোগের তির ছিল অবশ্যই জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের দিকে। কারণ, বিগত এক বছরে ছাত্র নেতা-সমন্বয়কদের যে পরিমান দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও জুলুমবাজির অভিযোগ সামনে এসেছে তাতে সমাজের একটা বড় অংশ সরে গিয়েছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং বিশিষ্টজনদের একাংশ এখন দুরত্ব বজায় রাখছেন। বিগত কয়েকটি সভা-সমাবেশেই তা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। প্রত্যাশার থেকে অনেক কম লোক হচ্ছে এনসিপি বা তাঁদের সহযোগী সংগঠনগুলির সভায়। লাগামহীন দুর্নীতি আর জুলুমের জেরে ছাত্রনেতাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমেছে। জানা যাচ্ছে, ৫ আগস্টের বড় কর্মসূচিতে লোক পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার পুলিশকর্তা ও প্রশাসনিক কর্তাদের বিশেষ নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় গোল বেঁধেছিল প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেবেন, তার বয়ান নিয়ে। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তাঁর সরকারের এক বছরের সাফল্য তুলে ধরতে হবে। কিন্তু বলার মতো সাফল্য কোথায়? বিগত এক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং কূটনীতিতে বড় কোনও সাফল্য নেই। নেই বড় কোনও প্রকল্প বা বিদেশি বিনিয়োগ। অথচ শেখ হাসিনার ফেলে যাওয়া রিজার্ভও এখন কমে এসেছে। শতাধিক কল-কারখানা খোলা যায়নি। বৈদশিক বাণিজ্য বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে ভারতের সঙ্গে শত্রুতা বাড়িয়ে। ফলে ইউনূসের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ নিয়েই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে শীতলতা নেমে এসেছিল। এখন একমাত্র ভরসা মিথ্যা প্রচার। যা নিয়ে নাকি দ্বিধাবিভক্ত উপদেষ্টাদেরই একাংশ।
Discussion about this post