রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মানবিক ও নীতিগতভাবে করিডোর দিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন এই কথাটি জানিয়েছেন। ২৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের এই কথা জানান। তৌহিদ জানান, রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পাঠানোর জন্য সরকার রাজি হয়েছে। তবে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। সেই শর্ত গুলি মানা হলে বাংলাদেশ সরকার সাহায্য করবে। অনেকেই বলছেন, এই বিষয়ে ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল সরকারের। তাহলে বাংলাদেশে হঠাৎ করে কেন এই সিদ্ধান্ত নিল, এবং সরকারের শর্তগুলি কি কি! আবার বাংলাদেশের এমন সিদ্ধান্তে বঙ্গোপসাগর রাজনীতির সঙ্গে জরিত মায়ানমার এবং তিন পরশক্তি রাশিয়া, চীন ও ভারতের প্রতিক্রিয়া কি হবে? শুরু হয়েছে জল্পনা।
মায়ানমারের পুরো রাখাইন রাজ্যটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত। সেখানে গোলাগুলি চলছে। মায়ানমারের জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত তীব্র হচ্ছে। আরাকান আর্মি নাকি ১৪ টি শহর দখলে নিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে ২৭১ কিলোমিটার এলাকা মায়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে। রাখাইন রাজ্যের সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। মায়ানমারের জান্তা বাহিনী কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছে আরাকান আর্মিকে। এর জেরে সমস্ত ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সহ বহু সংস্থা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবীয় সহায়তার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল সংস্থাগুলি। এমন প্রস্তাব প্রথম দি জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ত্রাণ সংস্থা স্পেশাল এডভাইজারি কাউন্সিল ফর মায়ানমার। গত বছর বাংলাদেশে ক্ষমতার বদলের পর এই সংস্থাটি এমন দাবি তুলে ধরেছিল। জানা যায়, ২০২৪ সালে ১৯ অগাস্ট একটি বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডর চালু করতে এবং রাষ্ট্রের সমস্ত জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানায়। এরপর থাইল্যান্ড ভিত্তিক মানব অধিকার সংগঠন ৪৫ রাইস বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানায়। সংস্থাটি গত ১১ ই মার্চ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গৃহ যুদ্ধের শিকার নাগরিকদের মানবতা সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডর দিতে বলেছে। তারা বলেছিল, জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে সীমান্তের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঠিক তার দু দিন পরেই বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তিনি গত ১৩ থেকে ১৬ই মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে। তিনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন সফল করতে মায়ানমারে মানবতা সহায়তা পাঠিয়ে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবেশ অনুকূল হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মানবতা সাহায্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই মায়ানমারে সংঘাতে জড়িত প্রতিপক্ষদের অনুমোদন এবং সমর্থন প্রয়োজন। এই প্রস্তাবের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা জল্পনা তৈরি হয়। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। সূত্র জানা যাচ্ছে, জাতিসংঘের এই প্রস্তাব স্পর্শকাতর। অন্তর্বর্তী সরকার নাকি তখন ভেবেছিল, নির্বাচিত স্থায়ী সরকার এসে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এমনকি প্রশ্ন ওঠে, কেন স্থায়ী সরকারের আমলে এই প্রস্তাব এল? কেন আগের সরকার থাকাকালীন বা ভবিষ্যতে স্থায়ী সরকার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হল না? অনেকে বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছেই নতিস্বীকার করেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, মানবিক করিডর দিতে রাজি হলেও বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। তবে তিনি এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু বলেননি। তবে মনে করা হচ্ছে, মূলত মায়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি লাভবান হবে। ফলে মায়ানমারের সরকার এর প্রতিবাদ জানাতেই পারে। তবে বাংলাদেশ সরকারের তরফে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে এক হল, রোহিঙ্গাদার ফেরত দিতে সম্মত হওয়া, নদীপথে বাণিজ্যে বাধা না দেওয়া, অপহরণ বন্ধ করা, মাদকের কোনও চালান যাতে আসা যাওয়া না করে, সেটা নিশ্চিত করা, করিডর দিয়ে কোনও ভারী অস্ত্র যাতে আনা নেওয়া না করা যায়। তবে এক্ষেত্রে অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরাকান আর্মি শক্তিশালী হতে পারে এবং তাতে বাংলাদেশ প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়ে যেতে পারে। এখন দেখার, শেষমেশ কি হয়।
Discussion about this post