বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের মধ্যে অম্ল মধুর সম্পর্ক এখন সবাই জানে। জেনারেল ওয়াকার যিনি গতবছর পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ইচ্ছা অনুসারে এই অন্তবর্তী সরকার গঠনে সাহায্য করেছিলেন। আবার কার্যত অনিচ্ছাসত্ত্বেও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা পদে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিগত ১০ মাসে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক ঝড়, যার বেশিরভাগটাই সাধারণ মানুষের অলক্ষে এবং অজান্তে। জেনারেল ওয়াকার এবং মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে দড়ি টানাটানি মাঝেমধ্যে খবরের শিরোনামে এলেও তা কোনও পক্ষই স্বীকার করতে চায়নি। ফলে বিশ্বাসযোগ্যতার একটা বাতাবরণ বরাবরই ছিল। কিন্তু এবার মুহাম্মদ ইউনূস ভোট ঘোষণা নিয়ে নানা টালবাহানা ও দর কষাকষি করায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান কার্যত বিরক্ত। প্রথমে ২০২৬-এর জুন মাস, তারপরে এপ্রিল মাস এবার ফেব্রুয়ারী মাসে ভোট হবে বলছেন মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু জেনারেল ওয়াকার এখনও অনড় ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করানোয়। যা নিয়ে দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে করছেন বাংলাদেশের ওয়াকিবহাল মহল।
আসল কথা হল, সেনাপ্রধান দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রথম রাউন্ডে জয়লাভ করেছেন। কারণ তিনি কেবল ইউনূসকে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার এবং প্রশাসনকে পুনঃগণতান্ত্রিক করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়েছিল। প্রথম দফায় জেনারেল ওয়াকার বিজয়ী হন, যখন তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কয়েকটি প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল ইউনূসবাহিনী। যেখানে জেনারেল ওয়াকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিই শেখ হাসিনাকে ভারতে নিরাপদে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরের রাউন্ডে সেনাপ্রধান সফল হন যখন রাখাইন করিডোর নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আপাতত পিছু হটতে বাধ্য করিয়ে। এবার শুরু হয়েছে তৃতীয় রাউন্ডের দ্বন্দ্ব। ভোট কি ডিসেম্বরের মধ্যে করাতে পারবেন জেনারেল ওয়াকার? নাকি এবার তাকে টেক্কা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ভোট নিজের ইচ্ছামত সময়ে করাবেন বা আরও সময় কিনবেন। এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে ভারতকে তুলে দেবে? উত্তর হলো “না”। কারণ বাংলাদেশে ক্রমাগত আওয়ামী লীগ নেতা এবং তাদের পরিবারকে হত্যা, তাদের বাড়িঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া। সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন, নির্বিচারে হত্যার ঘটনা গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। এই দাঙ্গা ও বিশৃঙ্খলা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভারত থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হলে শেখ হাসিনার ভাগ্য কেমন হবে। জেনারেল ওয়াকার এটা ভালোভাবেই জানেন। তাই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নিয়ে তাঁর মুখে একটাও কথা নেই। আসলে বিশ্ববাসীর স্মৃতি এত ছোট নয় যতটা প্রায়শই বিশ্বাস করা হয়। যেখানে বিশ্ব ভালোভাবেই মনে রেখেছে যে কীভাবে জেনারেল জিয়া-উল-হক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উৎখাত করেছিলেন, যাকে পাকিস্তানে একটি মিথ্যা মামলায় আদালতের আদেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যখন টিম ইউনূস বারবার ভারতকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে হাসিনাকে একাধিক ফৌজদারি মামলায় বিচারের জন্য ফেরত পাঠানো হোক, যেখানে মৃত্যুদণ্ডই সর্বোচ্চ শাস্তি। তখন গোটা বিশ্ব নয়াদিল্লির অনীহা বুঝতে পেরেছে এবং নীরব প্রশংসাও করছে। একমাত্র ক্ষমতার লোভে অন্ধ মুহাম্মদ ইউনূস সেই দেওয়াল লিখন পড়তে পারছেন না। তাই নির্লজ্জের মতো ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর থেকে প্রত্যাঘাত হয়ে ফিরেছেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমশ কোনঠাসা হচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনুস। তাই জেনারেল ওয়াকারের সামনে এটাই শেষ সুযোগ।
জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান তাঁর জাতিকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে পেরেছেন বলে মনে করা হচ্ছে যে, তিনি অনির্বাচিত হলেও ইউনূসের বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছেন না। তাঁকে অনবরত সময় দিয়ে চলেছেন। তবে, ইউনূসের সরকার যদি প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার নতুন কারণ এবং যুক্তি আবিষ্কার করে, তখন তাঁর হাতে দ্বিতীয় কোনও উপায় থাকবে না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও এখন চাইছেন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবসান হোক। কারণ তাদের মহোভঙ্গ হয়েছে বিগত দশ মাসে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, হাসিনার অধীনে বিতর্কিত পরবর্তী অংশ সহ -বাংলাদেশে কয়েক দশকের গণতন্ত্রে দেশের বাইরের ষড়যন্ত্রকারীদের এবং দেশের ভেতরের অপরাধীদের কল্পনার চেয়েও বেশি সফল করেছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মুসলিম কট্টরপন্থী সংগঠনগুলি যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে অচিরেই বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমানাধিকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে বিশ্বাসে পর্যবসিত হতে শুরু করেছে। তাই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রতি, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে সশস্ত্র বাহিনীতেও সেই উগ্রপন্থী বা চরমপন্থী উপাদান রয়েছে। কিন্তু তা সংখ্যায় সীমিত। যদি স্বার্থবাদী ইসলামিক গোষ্ঠীগুলি যারা জাতির জন্য মৌলবাদী ধর্মীয় এজেন্ডাকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তাঁরা এখন ভয় পাচ্ছেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামানকে।
টিম ইউনূস ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে। তাঁদের নির্বাচনী নিবন্ধন বাতিল করেছে। যদিও লন্ডনে বসে খোদ ইউনূস জানিয়েছেন যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়নি, তাঁদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করলেন ইউনূস। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মনে করে, আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার স্বাধীনতা ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এমনকি যদি হাসিনাকে মুক্ত পাখি হিসেবে দেশে ফিরে যাওয়ার বিকল্প নাও দেওয়া হয়। তার দলের কর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া উচিত। এই কথা ভারত-সহ বিশ্বের বহু দেশ বলছে। যেটা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের মনোবল বৃদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ইউনূস লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে একতরফা ভোট ঘোষণা করায় এবার ক্ষেপেছেন জামাত সহ এনসিপিও। জেনারেল ওয়াকারের কাছে এটাও প্লাস পয়েন্ট। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে মুহাম্মদ ইউনূস ক্রমশ কোনঠাসা হচ্ছেন। তাঁর এবং তাঁর সরকারের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। তাই এখন দেখার, জেনারেল ওয়াকার ডিসেম্বর মাসে ভোট করানো নিয়ে কোনও পদক্ষেপ নেন কিনা। কারণ প্রথম দুই রাউন্ডে তিনিই বিজয়ী, তৃতীয় রাউন্ডেও তিনি এগিয়ে।
Discussion about this post