কথা ছিল, দেশত্যাগের ছয় মাস পর ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দেবেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় ভারত থেকে ফেসবুক, ইউটিউব বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার হবে। আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, মূলত দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের প্রতি হবে সেই ভাষণ। কিন্তু এরই রাতের ঘুম উড়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। কারণ তাঁরা এই মুহূর্তে ব্যাস্ত নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে। সেখানে যদি আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা আবার রাজনীতির ময়দানে ফিরে আসে, তাহলে তাঁদের সাড়ে সর্বনাশ। সেই আশঙ্কা থেকেই কাঁপুনি ধরেছিল হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম বা মাহফুজ আলমদের। আর সেই কাঁপুনি বা ভয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে নিল জামাত শিবির। ট্রাপে পড়ে গেল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা।
শেখ হাসিনার ভাষণের বিরুদ্ধে অন্য একটি কর্মসূচি রেখেছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে ঠিক ছিল তারা শেখ হাসিনার ভাষণের সময়ে ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় গণঅভ্যুত্থানের ডকুমেন্টারি প্রচার করবে। ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে প্রজেক্টর লাগিয়ে জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ভিডিও সম্প্রচার করা হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন ছাত্রনেতারা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলিকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে তারা নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে কোনভাবেই শেখ হাসিনার বক্তব্য সম্প্রচার করা না হয়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই মুহূর্তে ততটা কি সরকার ও বাংলাদেশ প্রশাসনের ওপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব যথেষ্টই, ফলে সংবাদ মাধ্যমগুলি তাদের এই নির্দেশ মেনেই চলত। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য কারণে তাঁরা শেষ মুহূর্তে নিজেদের পরিকল্পনা বদলান, এবং ঢাকার ধানমন্ডি রোডে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্মৃতি সম্বলিত বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক দেন। বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা এর জোরদার প্রচারও করল বুধবার বিকেল থেকে। আর সন্ধ্যে নামতেই দেখা গেল ঢাকার রাস্তায় গত জুন-জুলাইয়ের সেই চেনা ছবি। হাতে সাবল, গাইতি, হাতুড়ি, লোহার রড নিয়ে হাজারো হাজারো উন্মত্ত ছাত্র-জনতা মিছিল করে এগোতে শুরু করলেন ধানমন্ডির সেই বিখ্যাত বাড়িটির দিকে। মুখে তাঁদের স্লোগান “ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”, নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’। ঠিক যেমন কোনও জঙ্গি সংগঠন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত ধানমণ্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িটি ধ্বংস করে কার কী লাভ হল? এই বাড়িটি সন্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিনেই। সেই বাড়িটিতে থাকা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল দস্তাবেজ সব পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল সেদিনই। এরপর সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়িটির কঙ্কাল। তাহলে ঠিক ছয় মাস পর কেন সেই কঙ্কাল ধুলিষ্যৎ করার পরিকল্পনা হল? রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আসলে মুখোশ, আসল মুখটি হল জামায়তে ইসলামী। তাঁরাই পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। জামাতের উদ্দেশ্য হল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলা, পাকিস্তানের প্রচার করা। তাঁরা সেটাই করে চলেছে নীরবে। এবারও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সমস্ত সম্পত্তি, বাড়িঘর যা ছিল সবকিছুই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল এক রাতের মধ্যে। রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে এই ঘটনা নতুন করে আওয়ামী লীগের পালে হাওয়া লাগতে পারে। অর্থাৎ বুধবার রাতের ধ্বংসলীলা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের একটা অংশ মনে করছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ট্রাপে পড়ে গেলেন। এই ঘটনা তাঁদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আগে একটা কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে। বাংলাদেশের মাটিতে আওয়ামী লীগ যে একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি সেটা প্রমাণিত হয়েছে ১ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি চলা তাঁদের লিফলেট বিলি কর্মসূচি থেকে। রাজধানী ঢাকা-সহ সে দেশের বহু এলাকায় তাঁরা প্রকাশ্যে লিফলেট বিলি করেছেন, মিছিলও করেছেন। গ্রেফতার বরণ করেছেন ছাত্র লীগের সমর্থকরা। আবার কোনও কোনও জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেফতার করতে এলে পুলিশকেই বাঁধা দিয়েছে গ্রামবাসীরা। এমনকি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। এখনও বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও আছে। তাঁরা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার এই জঘন্য প্রয়াস। আর তাঁদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালল বুধবার রাতের এই ধ্বংসলীলা। ফলে অচিরেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে এই ধ্বংসলীলা।
Discussion about this post