ইজরায়েল ও ইরানের যুদ্ধে এবার সরাসরি ঢুকে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, মার্কিন বিমানবাহিনী ইরানের পারমানবিক অস্ত্রভাণ্ডারগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি দাবি করেছিলেন, রবিবার শেষরাতে ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্র ফরদো, নাতানজ ও ইসফাহান লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল মার্কিন বমারু বিমান বি২। এই হামলায় ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ওই তিন পরমাণু ঘাঁটির। কিন্তু ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমানু ঘাঁটি কি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে মার্কিন বোমারু বিমানের হামলায়? পরবর্তী সময়ে কয়েকটি উপগ্রহ চিত্র অবশ্য সেই দাবি নস্যাৎ করছে। সেই উপগ্রহ চিত্রগুলিতে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন হামলার অনেক আগে থেকেই ওই তিনটি সাইটে বড় বড় পরিবহন ট্রাকের সারি। মনে করা হচ্ছে, ইরান হয়তো হামলার আশঙ্কা করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাজ-সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলেছিল আগেভাগেই। তবে এই সমস্ত আলাপ আলোচনাকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বড় আকার ধারণ করেছে যে চিন্তা সেটা হল বিশ্ব বাজারে তেলের জোগান। ইতিমধ্যেই তেলের দাম ছুঁয়েছে গত পাঁচ মাসের সর্বোচ্চ সীমা। তার জেরেই সোমবার তীব্র ধস নামল এশিয়ার শেয়ার বাজারে। এখন বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের চোখ এখন তেহরানের প্রতিক্রিয়ার দিকে।
রবিবারই এক্স হ্যান্ডেলে বিবৃতি জারি করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেই। কারও নাম না করেই তিনি লেখেন, ‘জায়ানবাদী বা ইহুদি মতাদর্শের শত্রুরা বড় ভুল করে ফেলেছে। যে অপরাধ ওরা করেছে তার শাস্তি ওদের পেতেই হবে। ইতিমধ্যেই ওই অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী দিনেও তা জারি থাকবে’। এরপরই খামেনেইয়ের উপদেষ্টা আলি শামখানি একটি বিবৃতি দেন এক্স হ্যন্ডলে। তিনি লেখেন, পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে ঠিকই, তবে খেলা এখনও শেষ হয়নি। যা নিয়ে শঙ্কিত গোটা বিশ্ব। কারণ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার মনোভাব সামনে আসতে ইতিমধ্যেই ইরানের পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁরা হরমুজ প্রণালী অবরুদ্ধ করবে। যা বিশ্বের তেলের জোগানের অন্যতম রুট হিসেবে চিহ্নিত। ইরান বিশ্বের নবম বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ। দিনে প্রায় ৩৩ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে তেহরান। যার অর্ধেক রফতানি হয়, বাকি অর্ধেক দেশের ঘরোয়া চাহিদা মেটানো এবং ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করা হয় বলে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান ব্ল্যাক মার্কেটে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করেই বিপুল অর্থ জমা করেছে, যা তাঁদের পারমানবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, হরমূজ প্রণালী বন্ধ করে দিলে কি হবে? বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালী। সংকীর্ণ এই জলপথ দিয়েই বিশ্ববাজারের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ তেল এবং এক-চতুর্থাংশ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহন হয়। এই প্রণালী দিয়ে শুধু ইরান নয়, প্রতিবেশী ইরাক, সৌদি আরব ও কাতারের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবাহী জাহাজ চলাচল করে। ফলে হরমুজ প্রণালী যদি ইরান অবরুদ্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের হাহাকার তৈরি হয়ে যাবে। ফলে সকলেরই নজর এখন ওই দিকেই। ইরানের এই ঘোষণার পর ইতিমধ্যেই এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ার বাজারে ধ্বস নামা শুরু হয়েছে।
ইরান, ইজরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে চিন। কারণ, চিন তাঁর মোট তেল আমদানির প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ইরান থেকেই কেনে। তা যেমন সরকারিভাবে আমদানি করা হয়, তেমনই ইরানের ব্ল্যাক মার্কেট থেকেও কিনে আনে বেজিং। এবার যুদ্ধের জেরে বিপদে পড়েছে চিন। যার সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকেই দায়িত্ব নিয়ে বলছে ইরানকে বোঝানোর জন্য। আমেরিকার বিদেশসচিব মার্কো রুবিওর বক্তব্য, হরমুজ় প্রণালী নিয়ে ইরানের সঙ্গে কথা বলা উচিত চিনের। মার্কো রুবিওর কথায়, আমি চাই চিন সরকার যেন এ বিষয়ে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কারণ চিন তাদের তেলের জন্য হরমুজ় প্রণালীর উপর ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল। এর আগে ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে আমেরিকার হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল বেজিং। ওই হামলায় আমেরিকা আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে বলেও দাবি করে চিন। অন্যদিকে রাশিয়া আবার সরাসরি ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ক্রেমলিন জানিয়ে দেয়, প্রয়োজনে রাশিয়া ইরানকে পরমানু কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে। সবমিলিয়ে ইরান এই মুহূর্তে একা নয়, তাঁদের পাশে অন্তত চিন ও রাশিয়া আছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। তবে, এই মুহূর্তে ইরানের পাশে নেই মধ্যপ্রাচ্যের বহু ইসলামিক দেশ। সেই কারণেই হরমুজ প্রণালী অবরুদ্ধ করা নিয়ে ইরান সিদ্ধান্ত নিলেও প্রয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্থ। এখন দেখার কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
Discussion about this post